যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতকে রেখে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না

সাব্বির খানসাব্বির খান
Published : 15 April 2011, 02:05 PM
Updated : 26 Oct 2013, 05:09 PM

দেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে বিশেষ আদালতে। অথচ যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর বিচার হবে না, বিষয় দুটো সম্পূর্ণ স্ববিরোধী এবং হঠকারী।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, একজন ব্যক্তির বিচার হতে পারে, তার ফাঁসি বা কারাদণ্ড হতে পারে; কিন্তু একটা দলের ক্ষেত্রে তা কীভাবে সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানেই। সেই আদি সংবিধানে জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে শুধু নিষিদ্ধই করা হয়নি, সে সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকারই ফিরে পায়নি, বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো জেহাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে। বিএনপি 'অগ্রজ জামায়াতের' একটি অগ্রবর্তী দল হিসেবেই এ দেশে চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছে এবং এখনও করছে।

কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতায় থেকেও স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলগুলো কী করছে, সেটাই বিবেচ্য বিষয়।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের বিচারের বিষয়টিও যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং একটা বাদ দিয়ে অন্যটা যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেটা শহীদজননী জাহানারা ইমাম আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে বুঝলেও, স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার যে বুঝতে পারছে না, অবস্থাদৃষ্টে তা আর বলার অবকাশ রাখে না।

দাবির স্বপক্ষে সারাদেশে জনমত তৈরি করতে নির্মূল কমিটি কাজ করেছে বছরের পর বছর এবং যার সুস্পষ্ট ফলাফল আমরা দেখেছি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সরকার একাত্তরের অপরাধীদের বিচার করার ওয়াদা করেই জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। সরকার যদি একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের অপরাধের বিচার করে, তাহলে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে হবে।

বিষয় দুটি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থাৎ একটাকে অস্বীকার করা মানে অন্যটাকেও অস্বীকার করা। কোনো ব্যক্তিকে যদি একাত্তরের অপরাধের জন্য দণ্ড হিসেবে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়– সেই ব্যক্তির আদর্শের সূতিকাগার যে দল– যে দলের আদর্শে এবং আদেশে উজ্জীবিত হয়ে সে গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেছে-– সেই আদর্শের এবং দলের বিচার কেন হবে না?

ইতোমধ্যে আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। অর্থাৎ জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনে দলগতভাবে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। যেসব কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে তা হল–

১. জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেই সঙ্গে আইন প্রণয়ণে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও স্বীকার করে না।

২. গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজেকর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল।

৩. নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনও কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না।

৪. কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে, তাদের জন্ম ভারতে; বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।

শুধুমাত্র এই চারটি কারণ পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, জামায়াত সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের ভৌগলিকতা তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধীতাকারীই শুধু নয়, স্পষ্টতই দেশের বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ একটি দল। ঐতিহাসিকভাবেও একাত্তরে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে মানবতার বিরুদ্ধে সীমাহীন অপরাধ করেছিল।

বিশ্বের কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ এ ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে পারে শুধুমাত্র বহিঃশত্রুর দ্বারা। অথচ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে, সম্পূর্ণ বাধাহীনভাবে এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের শতভাগ সুবিধা ভোগ করে, এ দেশের বিরুদ্ধেই ক্রিয়াশীল একটি দল হিসেবে বহাল তবিয়তে আছে।

দলটি গত জোট সরকারের অংশীদার হয়ে মন্ত্রিত্বের আসনে বসে বাংলাদেশের পতাকাবাহী গাড়ি দাবড়িয়ে বেরিয়েছে। এর অযৌক্তিকতা কারও নজরে না পড়ার কোনো কারণ নেই। অথচ 'সব সম্ভবের দেশ' বাংলাদেশে এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের বাংলাদেশি শাখা। এটির সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে, ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী, হিন্দ। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশে নয়, মিশর ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম ব্রাদারহুড এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবান ও আল কায়েদার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জঙ্গি মৌলবাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে।

জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের এক ও অভিন্ন দর্শন হচ্ছে, 'ধর্মের নামে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য যে কোনো ধরনের হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস ইসলামসম্মত।' মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন, যার বলয় মিসর পেরিয়ে সারাবিশ্বেই বিস্তৃত। নামে ভিন্নতা থাকলেও আদর্শগত মিলের কারণে বিশ্বের তাবৎ জঙ্গি মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঢাকা এসেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবুল আলা মওদুদীর পুত্র হায়দার ফারুক মওদুদী। সংবাদপত্রে দেখেছি, জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছিল।

খোদ মওদুদীপুত্র তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, "যে দল বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে সে দলের এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই, সে দলকে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত নয়। জারজ সন্তানের যেমন পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার থাকতে পারে না তেমনি বাংলাদেশেও জামায়াতের রাজনীতি করার নৈতিক বা সাংবিধানিক অধিকার থাকতে পারে না।''

তাঁর জবানিতেই জানা যায় যে, জামায়াতকে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই নিয়মিত টাকা দেয়। তিনি আরও বলেন, ধর্মের নামে গুণ্ডামি, বদমাইশি যেমন জায়েজ, আইএসআই-এর কাছ থেকে টাকা নেওয়াও জায়েজ বলে মনে করে জামায়াত। অবাক করে দিয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলও (বিএনপি) নিয়মিত আইএসআই-এর কাছ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকে এবং বিএনপি বাংলাদেশে যত জঙ্গি মৌলবাদী দল আছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।

অবশ্য মওদুদীপুত্রের উল্লিখিত এই কথাগুলোর সত্যতা ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি গত জোট সরকারের আমলে। সে সময়ে কোনো রাখঢাক না করেই বিএনপি-জামায়াত দেশজুড়ে যে ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালিয়েছিল, এক কথায় তা নজিরবিহীন! বিএনপি এর আগেও ক্ষমতায় এসেছে। মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে দেশের বারোটা তারা আগেও বাজিয়েছে। কিন্তু জামায়াতকে নিয়ে একসঙ্গে যখন ক্ষমতার মসনদে বসেছে, তখন দেখেছি, এই দেশ এবং দেশের মানুষদের তারা কতটা ঘৃণা করে। দেশটাকে তারা কোনোদিনই যে নিজের দেশ বলে ভাবেনি, তার সুস্পষ্ট নজির তারা রেখে গেছে তাদের প্রতিটা পদক্ষেপেই। একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধের সেই তো ছিল তাদের মোক্ষম সময়।

নতুন প্রজন্ম একাত্তরে এই হায়েনাদের বর্বরতা দেখেনি। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সারাদেশে যে ভয়ংকর তাণ্ডব এরা চালিয়েছে, যে অত্যাচার-নিপীড়ন, খুন-ধর্ষণ চলেছে, সংখ্যালঘুদের উপর যে অমানবিক নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে– এক কথায় তা একাত্তরের পুনারাবৃত্তিরই সামিল। নতুন প্রজন্ম তা দেখেছে। আর তাই পরবর্তীতে জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রজন্মের ঘৃণার গভীরতা দেখেছি প্রজন্ম চত্বর শাহবাগে।

গত জোট সরকারের আমলে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, বিশেষ করে জামায়াতের মদদে একশ'র বেশি জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠন এবং প্রায় পাঁচ শতাধিক ইসলামিক এনজিওর আবির্ভাব ঘটেছিল এদেশে। এদের তৎপরতা ছিল মূলত কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে। বিভিন্ন সময়ে এসব এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের জবানবন্দিতে জানা যায় জামায়াতের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা। কীভাবে তারা জামায়াতের টাকায় এবং অস্ত্রে বলিয়ান হয়ে দেশব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা চালিয়েছিল এবং বার্মার আরাকানের সঙ্গে কক্সবাজারসহ পার্বত্য চট্রগ্রামের একটা অংশকে নিয়ে তারা একটা আলাদা ইসলামি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

২০১০ সালে সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের 'জিহাদের প্রতিকৃতি' নামক প্রামাণ্যচিত্রে জামায়াতের সঙ্গে বার্মা-বাংলাদেশের সীমান্তে 'আরএসও'সহ রোহিঙ্গাদের ১৭ টি জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ তথ্যসহ তুলে ধরা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রটিতে পাকিস্তানের আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ মদদে জামায়াতের সহযোগিতায় একটি আলাদা মুসলিম রাজ্য গঠনের নীল নকশার গোপন চিত্র শাহরিয়ার জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন।

জোট সরকারের আমলে আমরা দেখেছি বাংলা ভাইয়ের আবির্ভাব। কী বীভৎসভাবে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে মানুষ মেরেছে, জীবন্ত মানুষের চোখ তুলে ফেলেছে তারা! কীভাবে চোরাগুপ্তা বোমা হামলায় বিচারপতি, সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ আর সাধারণ মানুষ মেরেছে। একই দেশে যেন দুই ধরনের শাসন তখন চলছিল। আজ্ঞাবহে বাধ্য করা প্রশাসনকে তখন এইসব বাংলা ভাইদের সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। দেশে যেন এক অঘোষিত নিরব নিধনযজ্ঞ চলছিল তখন।

আমরা দেখেছি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট কী বর্বরোচিতভাবে আর্জেস গ্রেনেড ছুঁড়ে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে ওরা। হামলায় আওয়ামী লীগের প্রায় ৬০ জনের মতো নেতা-কর্মী মারা গিয়েছিলেন। পরে বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল ওই গণহত্যাকাণ্ডে বিএনপি-জামায়াতের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কথা। শত শত হিন্দুর বাড়িঘরে, মন্দিরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল তখন জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। যে ১০ ট্রাক বেআইনি অস্ত্র ধরা পড়েছিল, তার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন তদানীন্তন জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিযামী। রমনার বটমূলে বোমা আক্রমণের কথাও কি কেউ ভুলেছে! একযোগে ৬৪ জেলায় একই সময়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জামায়াতপুষ্ট জঙ্গিরা তো রীতিমত বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফেলেছিল।

এ রকম হাজার হাজার ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যাবে। লিখে শেষ করা যাবে না জামায়াতে ইসলামীর বাঙালি নিধনের কথা। কোনো সভ্য দেশে এগুলো কল্পনাও করা যাবে না।

১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী যা কিছু করেছে, তার একটিও বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় করেনি। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল যে প্রত্যয় নিয়ে, দলটি হচ্ছে ঠিক তার বিপরীতমুখী একটি 'অশুভ শক্তি'। এ অশুভ শক্তি পেট্রো-ডলার আর আইএসআই-এর মদদে পরিপুষ্ট হয়ে বাংলাদেশকে একাত্তরের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে তৎপর থেকেছে সর্বক্ষণ।

আর তাই ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তিবেষ্টিত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জঙ্গি মৌলবাদের যে ভয়াবহ উত্থান ঘটেছিল, শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেই জঙ্গি দমনে যথেষ্ট সফল হলেও, জঙ্গিদের গডফাদার জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের অর্থযোগানদাতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।

জামায়াতকে রেখে বাংলাদেশের মাটি থেকে জঙ্গি মৌলবাদ উৎখাত অকল্পনীয় এবং হাস্যকর। তাই তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ সরকারের একটা অংশ জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিলেও, সরকারি দলগুলোর ভিতরে ঘাঁপটি মেরে থাকা জামায়াতের পেইড এজেন্টরা যেন তাদের চেয়েও শক্তিশালী।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিটি রায়েই একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দল হিসেবে জামায়াতের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা ট্রাইব্যুনাল সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। অথচ কোনো এক অদৃশ্য কারণে সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে বরাবরের মতোই চুপ থাকা হচ্ছে।

একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি শুধু কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে জামায়াত, রাজাকার, আলবদরদের বিচার করা না হয়, তাহলে এই বিচারও প্রহসনে পরিণত হবে। গোলাম আযম-কাদের মোল্লারা যে অপরাধ করেছিলেন, তা নিশ্চয়ই শুধু ব্যক্তির ইচ্ছা বা অনিচ্ছার বিষয় ছিল না। এগুলো ছিল একটা দেশের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট একটি দলের আদর্শিক এবং রাজনৈতিক এজেন্ডা। গণহত্যা ছিল মূলত একটা ভয়াবহ 'এথনিক ক্লিনজিং', যার উদ্দেশ্যই ছিল একটি জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ইসলামের নামে ফ্যাসিস্ট মওদুদীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জন্ম দিয়েছে জঙ্গি মৌলবাদের; হেফাজত আর খেলাফত আন্দোলনের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের। জঙ্গিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ধর্মের তকমায় এঁটে দেওয়া হচ্ছে বৈধতা।

জামায়াতের বিচার হতে হবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য। জঙ্গি-সম্পৃক্ততা তথা দেশব্যাপী ত্রাস-সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অপরাধে। বিচার করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যার জন্য। মানুষভর্তি বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার জন্য। সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করার জন্য।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলা ছিল; জামায়াত নিষিদ্ধের কথা ছিল না। কারণ একই কথা দুবার লেখার বা বলার দরকার হয় না বলে। মানবতাবিরোধী অপরাধে ব্যক্তির বিচার করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অপরাধের প্ররোচকেরও বিচার করতে হয়। ন্যায়বিচারের খাতিরে খুনির সঙ্গে খুনের হুকুমের আসামীরও বিচার করার কথা। এটাই আইনের সিদ্ধান্ত। অন্যথায় অপরিপূর্ণ বিচারের সঙ্গে আইনের শাসনেরও মারাত্নক বরখেলাপ হয়।

বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এবং গণতন্ত্র সুসংহত করার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। এর বরখেলাপ হলে শুধু স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকেই নয়, সারাদেশের জণগণকেই মাসুল দিতে হবে।

জামায়াতকে রেখে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। এর ব্যত্যয় ঘটলে আগামী নির্বাচনে এর সুস্পষ্ট নেতিবাচক ছাপ পড়তে বাধ্য।

সাব্বির খান: আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।