সাজিদুল হক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 2021-12-16 00:03:56 BdST
এই মন্ত্র শিখিয়েছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিব। তার জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপনের মধ্যেই এসেছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণ।
দেশবাসীকে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “আসুন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরো বেশি অবদান রাখি, দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’। মহান বিজয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের পা আটকে ছিল পাকিস্তানি বেড়িতে। সেই শেকল ভাঙার মন্ত্র শেখানো শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাংলার মানুষের ভালোবাসার বঙ্গবন্ধু।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদারের আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধুই দেন স্বাধীনতার ডাক, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তা সফল পরিণতি পায় নয় মাস পর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন যুদ্ধে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্মযুদ্ধে জয়ের দিন।
বিশ্বের হাতেগোনা যে কটি দেশের স্বাধীনতা দিবসের পাশাপাশি বিজয় দিবসের মতো উৎসবের উপলক্ষ রয়েছে, তার একটি বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বিশেষ আয়োজন থাকছে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। তাই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে চলছে সাজসজ্জা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
দুই দশক পর ক্ষমতায় ফিরে দেশকে রাহুমুক্ত করার কাজে হাত দেয় বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। ওই সময়ই স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন করে বাংলাদেশ।
রাজনীতির খেলায় ২০০১ সালে আবার ঘটে ছন্দপতন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরে ২০০৯ সালে। তার পর এক যুগ ধরে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের মধ্যেই এসেছে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুখবর।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা সূচকে অগ্রগতির পর বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের কাতারে পৌঁছানো।
অর্থনীতিতে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ তকমা পাওয়া বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্যে দিয়ে মহাকাশে লাল-সবুজ পতাকা স্থাপন করেছে। নিজস্ব আয়ে পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পও শেষ করে এনেছে সরকার। শেষ হওয়ার পথে মেট্রোরেলের মত বড় প্রকল্প। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাবে আর কিছু দিনের মধ্যে।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় পাওয়া বাঙালির গত ৫০ বছরের চলার পথও মসৃণ ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের সঙ্গে থেকে থেকেই লড়তে হয় বাংলাদেশকে। শত বাধা অতিক্রম করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার প্রাণশক্তি এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, প্রবাসী কর্মীরা। খেটে খাওয়া মানুষের শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠছে অর্থনীতির ভিত।
বিজয় দিবস উদযাপন ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে শিক্ষা ভবন সেজেছে আলোর সাজে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
সাতক্ষীরার এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আগামীর বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রথম তিনটি গুণ আগে থাকতে হবে। দেশপ্রেমিক, দেশপ্রেমিক এবং দেশপ্রেমিক। এরপর তাকে দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদের স্বচ্ছ হতে হবে। দল-মতের উর্ধ্বে উঠে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন আট নম্বর সেক্টরের এই যোদ্ধা চান আগামীর বাংলাদেশে দায়িত্বশীলরা যেন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে।
“একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি চাই, আগামীর বাংলাদেশে যেন সবাই সবাইকে সম্মান করবে। যার যার অবস্থান থেকে অপরকে সম্মান করবে। আমাদের সন্তানরা যাতে অপদস্থ না হয়, সেদিকে রাষ্ট্র নজর রাখবে। আর যার যা দায়িত্ব তাকে সেটা পালন করতে হবে।”
জীবদ্দশায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারা শেখ তৈয়বের জন্য ‘বড় স্বস্তি’।
“বঙ্গবন্ধুর দেওয়া দেশে তার মেয়ের নেতৃত্বে রাজাকারদের বিচার হয়েছে, এটা যে কত বড় স্বস্তি, তা বলে বোঝানো যাবে না। দেশ এই ৫০ বছরে অনেক এগিয়েছে। কিছু ত্রুটি আছে। সেটা সব জায়গায় থাকে। সামনের দিনে আরও এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ আয়োজনকে সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে বিজয়ের রক্তিম শুভেচ্ছা জানিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে রাজধানীর বিজয় সরণিতে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ফারজানা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ, সেই আদর্শ সামনে রেখে আগামীর বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিভাজন চাই না। বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০, এই সময়ে এই প্রজন্মের মানুষ হিসেবে আমি চাই অসাম্প্রদায়িক, বিভেদমুক্ত, সকলের রাষ্ট্র।”
“এই প্রজন্মের একজন মানুষ হিসেবে চাই, সকলের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। অর্থনীতিতে যে উন্নয়ন বাংলাদেশ করছে, তার সুফল যেন প্রতিটি মানুষ পায়, এটাই চাওয়া।”
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বিশাল পরিসরে পালনের যে পরিকল্পনা ২০২০ সালে নেওয়া হয়েছিল তাতে বাধা পড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে।
পরে মুজিববর্ষের মেয়াদ ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ উদযাপন করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
স্বাধানীতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর জোড়া আয়োজন একসঙ্গে চলে দশ দিন ধরে। প্রতিবেশী দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতারাও তাতে অংশ নেন।
এবার বাঙালির মহাবিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে নেওয়া হয়েছে দুই দিনের অনুষ্ঠানমালা। তাতে যোগ দিতে বুধবার ঢাকা পৌঁছেছেন বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গী দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ।
রাজধানীর সড়কগুলো সাজানো হয়েছে লাল-সবুজের মনোরম সাজে। সড়কদ্বীপগুলোতে শোখা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড। বিভিন্ন স্থাপনায় হয়েছে আলোকসজ্জা।
বৃহস্পতিবার বিজয় দিবসের সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চিরায়ত আয়োজনে উদযাপনের সূচনা হয়।
পরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে হয় বিজয় দিবসের বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ, যাতে প্রথমবারের মত বন্ধু দেশ ভারত, ভুটান, রাশিয়া ও মেক্সিকোর সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও অংশ নেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন।
বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হবে এবারের মূল আয়োজন। বিকাল সাড়ে ৪টায় এ অনুষ্ঠানমালার সূচনা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালনায় সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের শপথে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেবে।
শপথগ্রহণ শেষে আলোচনা পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠান বিকাল সাড়ে ৪টায় শুরু হবে এবং রাত ৮টায় শেষ হবে। মাঝে বিকাল ৫টা থেকে ২৫ মিনিট বিরতি থাকবে। পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলবে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।
দুই দিনের অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারসহ বিভিন্ন সম্প্রচারমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।