ওবায়দুর মাসুম, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 2022-01-04 00:29:07 BdST
প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ বাড়ছে, তা মনে করছেন না তিনি।
তবে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. সমীর কুমার সাহা ভারতে ওমিক্রনের বিস্তারের দিকটি দেখিয়ে বলছেন, প্রতিবেশী দেশটিতে যেভাবে ওমিক্রনের রোগী বাড়ছে, তাতে বাংলাদেশেও তা অচিরেই বিস্তৃত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ওমিক্রনের বিস্তার বাংলাদেশে ঘটবে বলেই ধরে নিয়েছেন সরকারি সংস্থা আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীরও। তিনি মনে করছেন, আর দুই-এক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি বোঝা যাবে।
দুই বছর আগে বিশ্বে নতুন করোনাভাইরাস মহামারী বাঁধিয়ে দেওয়ার পর গত বছরের প্রথম ভাগে আসে এই ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।
ভারতে উদ্ভূত এই ভ্যারিয়েন্টের দাপটে দেশটিতে ত্রাহি অবস্থা তৈরি হয়। অক্সিজেনের সঙ্কটে মারা যেতে থাকে রোগীর পর রোগী।
ভারতের পর গত বছরের এপ্রিল থেকে বাংলাদেশেও পরিস্থিতি নাজুক করে তোলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। জুন-জুলাই-অগাস্ট মহামারীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করতে হয় দেশকে।
এরপর পরিস্থিতির যখন উন্নতি হচ্ছিল, তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেয় করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন।
আর এই ভ্যারিয়েন্টই এখন দাপট দেখাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অলিভার ভেরানের ভাষায়, ওমিক্রন যা ঘটাচ্ছে, তাকে আর সংক্রমণের ঢেউ বলা চলে না, এটা রীতিমতো ‘জলোচ্ছ্বাস’।
ওমিক্রন আর ডেল্টার দাপটে কোভিড ‘সুনামি’, শঙ্কিত ডব্লিউএইচও
ইউরোপে ওমিক্রন ‘ছড়াচ্ছে বিদ্যুৎগতিতে’
ভারতে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। ছবি: রয়টার্স
ভারতেও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ওমিক্রন। ইতোমধ্যে দেশটিতে ওমিক্রনে আক্রান্ত ১৭০০ কোভিড রোগী ধরা পড়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে নয়া দিল্লি সরকার, যার মধ্যে ১৭৫ জন শনাক্ত হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়।
ভারতে কোভিড রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে আবার দ্রুতগতিতে। গত এক সপ্তাহে ১ লাখ ৩০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে দেশটিতে, যা গত ১২ সপ্তাহে সর্বোচ্চ সংখ্যা।
ওমিক্রন: মহামারীর আরেকটি ঢেউ ঠেকানোর জুয়ায় ভারত
সংক্রমণ বাড়ার গতি বাংলাদেশেও একই রকম। এক সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৪৮ শতাংশ, মৃত্যুও বেড়েছে ৪২ শতাংশ। দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে ৩ মাস পর।
করোনাভাইরাস ডেল্টার চেয়ে দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে বলে উদ্বেগও বেশি। উদ্বেগ আরও বেড়েছে যখন জানা গেছে যে এটি টিকার সুরক্ষাও ভেদ করতে পারছে।
ফাইজারের টিকার সুরক্ষা ‘আংশিক ভেদ করতে পারে’ ওমিক্রন
ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকায় না ‘বেশিরভাগ টিকা’
এই পরিস্থিতিতে ওমিক্রন মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে সোমবার সচিবালয়ে এক জরুরি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
এখন রোগী বাড়ার সঙ্গে ওমিক্রনের সম্পর্ক রয়েছে কি না- জানতে চাইল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ বাড়ছে, এমন বেশি কেইস আমরা এখনও পাইনি।”
তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যাদের ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে, তারা সবাই বিদেশ থেকে এসেছেন বা বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশে গত ৯ ডিসেম্বর জিম্বাবুয়ে ফেরত দুই নারী ক্রিকেটারের দেহে প্রথম ওমিক্রন ধরন শনাক্তের কথা জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এরপর এ পর্যন্ত আরও আট রোগী শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার বাসিন্দা এই ১০ জনের মধ্যে ৭ জন নারী, তিনজন পুরুষ।
কোনো কোভিড রোগী কোন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত, তা জানার জন্য রোগীর দেহ থেকে নমুনা নিয়ে জিনবিন্যাস উন্মোচন করা প্রয়োজন। কিন্তু ওমিক্রন সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুধু বিদেশ ফেরতদের নমুনার জিনাম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে বলে এর আগে জানানো হয়েছিল।
সোমবার জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলমগীর বলেন, তারা বিদেশ ফেরতদের পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে এসে রোগাক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের নমুনারও জিনোম সিকোয়েন্সিং করছেন।
তবে এখানে একটি ফাঁক পাওয়া যায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এক কথায়। গত ৩০ নভেম্বর তিনি বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা ২৪০ জনকে খুঁজেই পাচ্ছে না সরকার, তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ।
ফলে তাদের মধ্যে কেউ ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে তা থেকে যদি অন্যদের মধ্যেও ছড়ায়, তবে তারা জিনোম সিকোয়েন্সের আওতায় আসেনি।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা ২৪০ জনেরই মোবাইল ‘বন্ধ’, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ‘আশ্চর্য’
ওমিক্রন: যুক্তরাজ্যে শনাক্তের চেয়ে আক্রান্ত ‘কয়েকগুণ বেশি’
মহামারী থেকে এখনও মুক্তি মেলেনি, কিন্তু পথচলায় অনেকের মুখ থেকে সরে গেছে মাস্ক। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু
ডা. আলমগীর বলছেন, বাংলাদেশে এখনও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টেরই প্রাধান্য চলছে। ওমিক্রনের বিস্তার এখনও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।
“ওমিক্রনের দুয়েকজন লোক পাওয়া যাচ্ছে। তবে যখন ওমিক্রন পাওয়া যাবে, তখন দেখা যাবে আক্রান্ত সবাই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় একই অবস্থা।”
“আমাদের এখানেও ওমিক্রন ছড়াবে। হয়ত আরও দুই-এক সপ্তাহ পর বোঝা যাবে” বলেন তিনি।
চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. সমীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারতে ওমিক্রনের অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে, এ কারণে বাংলাদেশে ওমিক্রন আসতে বেশি দেরি হবে না।
“ওমিক্রন আসবেই এটা সিম্পল কথা। এখন খুব কম হচ্ছে, কিন্তু খুবই তাড়াতাড়ি হবে, কারণ ইন্ডিয়াতে দ্রুত রোগী বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় খুব দ্রুত স্প্রেড করছে।”
ওমিক্রন পৌঁছেছে ১০৬ দেশে, ইউরোপে ‘ঝড়ের’ সংকেত
ওমিক্রন দ্রুত বিস্তার ঘটালেও এতে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার হার কম বলে আশ্বস্ত করেছেন এই চিকিৎসক।
“এটাই আশার কথা। তবে কোনো বিষয়েই আমাদের নিশ্চিত হয়ে থাকার মতো কিছু না। এটার বিস্তার যখন হবে তখন ভালোভাবেই হবে। যে কোনো সময় আক্রান্তের সংখ্যা অনেক হয়ে যেতে পারে।”
“আমি বলব ওমিক্রন নিয়ে আমাদের কনসার্ন আছে, কিন্তু প্যানিকড হওয়া যাবে না। সাবধানতা অবলম্বন করতে পারলে হয়ত এটা ঠেকাতে পারব,” বলেন তিনি।
টিকাও ওমিক্রন মুক্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না বলে উদ্বে বাড়ছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
ওমিক্রন মোকাবেলার বৈঠক করলেও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এনিয়ে বড় কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ওমিক্রনের বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোও পরে জানানো হবে।
বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন মানায় কড়াকড়ি আরোপের কথা বলেন তিনি। হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে ‘কম গুরুতর নয়’: গবেষণা
ওমিক্রন: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যা জানা গেছে
কারণ ‘স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্টই আসুক, তার বিস্তার ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। কিন্তু এখন মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার যে প্রবণতা, তাই রোগী বাড়িয়ে তুলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ হাজার ৫৪২ জন। ডিসেম্বরে শনাক্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৫৫ জনে। অর্থাৎ নভেম্বর মাসের তুলনায় রোগী বেড়েছে ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আক্রান্ত ৪৮ শতাংশ এবং মৃত্যু ৪২ শতাংশ বেড়েছে।
ডিসেম্বরের প্রথম তিন দিনেই রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬০১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৬৭৪ জন। এর আগে ৬ অক্টোবর ৭০৩ রোগী শনাক্ত হয়েছিল।
সোমবার নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এর বেশি শনাক্তের হার সর্বশেষ ছিল গত ২ অক্টোবর।
গত বছরের ৪ অক্টোবর নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে নামে। ১৯ অক্টোবর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই মাসের বেশি সময় শনাক্তের হার ২ শতাংশের নিচেই ছিল। ২৪ ডিসেম্বর তা ২ শতাংশের উপরে ওঠে। ১০ দিনের মাথায় তা তিন শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে গেল।
বিজয় দিবস ঘিরে তিন দিনের অবকাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ঢল নেমেছিল, যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিল না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “আমরা যেভাবে নানা অনুষ্ঠান করছি, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোও কিছুটা দুর্বল হয়ে আসছে। সংক্রমণ ছড়ানোর পেছনে সেটাই মূল কারণ।”
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলমগীরও বলছেন, “ওমিক্রন না হলেও বাংলাদেশে সংক্রমণ বাড়ছে। এর কারণে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। দেশজুড়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে।
“পার্টি হচ্ছে, ওপেন এয়ার কনসার্ট করছি, ইনডোরে কনসার্ট করছি। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে একমাত্র উপায় যে কোনো ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি।”
এত ভ্রমণ, এত রাজনৈতিক সমাবেশ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী শঙ্কিত
জনসমাগমের মতো কর্মসূচিতে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও, যদিও বাণিজ্য মেলার মতো আয়োজন সরকারি উদ্যোগেই হচ্ছে।
তিনি সোমবারের সভার পর বলেন, “সংক্রমণ বাড়তে থাকলে মৃত্যুহার বেড়ে যাবে। আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই।”
মাস্ক বাধ্যতামূলক করা, টিকা ছাড়া রেস্তোরাঁয় ঢোকার উপর বিধি-নিষেধ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
“করোনার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আবারও লকডাউনের কথা চলে আসবে, সব কিছুর উপরই একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যেটা আমরা চাই না,” বলেন তিনি।
লকডাউন এখনি নয়, রেস্তোরাঁয় খেতে লাগবে টিকা সনদ: স্বাস্থ্যমন্ত্রী