শাহবাগ: মহাকালের ইতিহাসে সমকালে সংযোজন

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 5 Feb 2014, 07:58 AM
Updated : 5 Feb 2014, 07:58 AM
ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে নানান কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া 'অমর একুশে ফেব্রুয়ারি'র গুরুত্ব এবং মাহাত্ম্য আমাদের জাতীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে– চিন্তা, চেতনা এবং দেশাত্মবোধের জাগরণে তো বটেই– বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।

একটি বিশেষ দিন হিসেবে 'একুশ' তারিখের বিশেষ আবেদন থাকলেও পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটাই তার গৌরব, গাম্ভীর্য, ত্যাগ, অর্জন এবং আবেগের তীব্রতা নিয়ে আমাদের জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ মাসের মর্যাদা পেয়েছে। এর যেমন রয়েছে নানান ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে বহুমাত্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য।

একটি জাতির গঠন, নির্মাণ এবং বিনির্মাণের পাটাতনের মজবুত ভিত্তি নির্মাণ করবার যে সাংস্কৃতিক-জাতীয়তাবোধ এবং ভাষাতাত্ত্বিক-রাজনৈতিকতাবোধ, সেটা মহান ফেব্রুয়ারির অমর একুশের হাত ধরেই বেড়ে এবং গড়ে উঠেছে। অতিসম্প্রতি 'অমর একুশে ফেব্রুয়ারি' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পাওয়ায়, ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব তার গৌরবোজ্জ্বল মাহাত্ম্য নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে।

তাই মহান ভাষা আন্দোলন, বাংলার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাপ্রাপ্তি, মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার্থে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের বিরোচিত শহীদী আত্মদান ফেব্রুয়ারি মাসকে আমাদের জন্য অবশ্য স্মরণযোগ্য মাসে পরিণত করেছে। এটা একটি বিশেষ আনন্দের বিষয় যে, ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় 'অমর একুশে'র কাতারে না-যুক্ত হলেও, ২০১৩ সাল থেকে এই মহান ফেব্রুয়ারি মাসেই আরও একটি উদযাপনের উপলক্ষ তৈরি হয়েছে আমাদের জাতীয় জীবনে।

বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়া সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ বাঙালির জাগরণের আরেক উপাখ্যান শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম। ইতিহাসের আরেক যোগসন্ধিক্ষণে সময়ের বিশেষ প্রয়োজনে শাহবাগের জন্ম মহান ফেব্রুয়ারি মাসের ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আরও অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

ইতিহাসের দায়মুক্তির দাবি সামনে রেখে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সূত্র ধরে এ সকল অপরাধে অভিযুক্তদের যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগ চত্বরে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব গণজোয়ার, সমকালীন ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে দেদীপ্যমান।

আজ সেই ঐতিহাসিক গণজোয়ারের বা গণজাগরণের বর্ষপূর্তি। বয়স-লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষ মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জন্ম নেওয়া 'শাহবাগ'কে কেন্দ্র করে আজ নানান বিচার-বিশ্লেষণ হবে; এক বছর পরে এসে এ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা-বিচার-বিশ্লেষণ চলবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। এ নিবন্ধে ভালো-মন্দের কিংবা সাফল্য-ব্যর্থতার মাপজোঁকে আমি যাব না।

তবে এটা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ এখন থেকে আসন্ন এবং দূরাগত ইতিহাসের হাত ধরে সমকালের ইতিহাস হিসেবে এর ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে মহাকালের মহাকাব্যে সগৌরবে জায়গা করে নেবে। আমি শাহবাগ আন্দোলনের কিছু সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক রূপান্তর এবং প্রাজন্মিক মেলবন্ধন নিয়ে আমার আলোচনার সীমানা নির্ধারণ করব।

কেন, কীভাবে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছিল, সেটা সাম্প্রতিকতম সময়ের একটি অতি জানা-ইতিহাস, কেননা আমাদের সকলেরই চোখের সামনে সে ইতিহাসের ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছে। ছয়টি অপরাধের মধ্যে পাঁচটি অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়ার সিদ্ধান্ত এদেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ মেনে নিতে পারেনি।

তাই তরুণ প্রজন্মের বাঁধভাঙা আবেগ গর্জে উঠেছিল এ শাহবাগের স্কোয়ারে। কেননা এ রায় এদেশের গণমানুষের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত করেনি, এদেশের মানুষের দেশপ্রেমের আবেগ ধারণ করেনি এবং এদেশের জন্ম-ইতিহাসে সংঘটিত হিংস্রতম বর্বরতা পরিহাস করেছিল। তরুণ প্রজন্ম তাই এ রায় প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে।

এর পরের ঘটনাপ্রবাহ হচ্ছে মহাকালের মহাকাব্যে সমকালের ইতিহাস হয়ে উঠবার কাহিনী। কালান্তরের ইতিহাসে শাহবাগের ক্রমান্বয়ে গৌরবোজ্জ্বল নজির হয়ে উঠবার কাহিনী। শাহবাগের ক্রমান্বয়ে দেশপ্রেমে-উজ্জ্বীবিত মানুষের তীর্থস্থান হয়ে উঠবার কাহিনী। শাহবাগে প্রজন্মের উত্থান ও জাগরণ কেন্দ্র করে সারা দেশে এবং প্রবাসেও যে গণজাগরণ হয়েছে, তা সমকালীন গণজাগরণের যে বৈশ্বিক উদাহারণ আছে তার সঙ্গে সমান এবং সমান্তরালে উদ্ধৃত করা হয়।

যেমন, অকুপাই ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট, মিশরের তাহরির স্কোয়ার কিংবা দিল্লির জন্তর-মন্তর একই উপমার আখ্যানে গ্রন্থিত হয়। তাই শাহবাগের গণজাগরণকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে এবং আগামী দিনের ইতিহাসবিদরা তার বাছ-বিচার করবেন। কিন্তু সমকালের ইতিহাসে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য নিঃসন্দেহে অপরিসীম এবং সে গুরুত্ব বিবেচনায় মহাকালের ইতিহাসে শাহবাগ একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী অধ্যায় হিসেবে সংযোজিত হবে।

কেননা শাহবাগের এ জাগরণ এদেশের রাজনীতির বাঁক পরিবর্তন করে দিয়েছে; এমনকি নির্ধারণ করে দিয়েছে আগামী দিনের রাজনীতির সড়ক-মহাসড়ক। এ জাগরণ এদেশের মানুষের মধ্যকার দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত আবেগ, অনুভূতি, এবং ক্ষোভ-বিক্ষোভকে যেমন অবগুণ্ঠিত করেছে, তেমনি সমাজের এবং রাজনীতির বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করে দিয়েছে।

তাই সমকালীন রাজনীতির স্বার্থপর দলীয়করণ এবং দেশপ্রেমহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি এ আন্দোলন এক অর্থে একটি তীব্র প্রতিবাদও বটে। সে অর্থে, এ-আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ গণমানুষের সম্পৃক্ততা, এদেশের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, পেশাজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মেহনতি মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত সম্পৃক্ততা বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ।

বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এদেশের আপামর গণমানুষের ক্রমবর্ধমান বিরক্তি ও বিমুখতা দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও ছায়ামুক্ত শাহবাগের গণজাগরণকে একটি সর্বজনীন ভিত্তি দিয়েছে। ফলে ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারির আট তারিখের মহাসমাবেশে লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতি এবং পরবর্তীতে দেশব্যাপী এ আন্দোলনের সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের গণসম্পৃক্ততা প্রকারান্তরে বিদ্যমান দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থারই 'প্রতীক'।

তবে অন্যান্য সকল কিছুর উর্ধ্বে শাহবাগ আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, অন্তত আমার কাছে, ইতিহাসের সঙ্গে এবং ইতিহাসের পরম্পরার সঙ্গে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপন করা। বিশেষ করে তিন প্রজন্মের– একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী বা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সরাসরি দর্শনকারী বা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রজন্ম, একাত্তর-উত্তর প্রথম প্রজন্ম এবং একাত্তর-উত্তর দ্বিতীয় প্রজন্ম বা অনাগত আগামীর প্রজন্ম– এর মধ্যে চেতনাগত একটা সুদৃঢ় মেলবন্ধন তৈরি করে দিয়েছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ।

এটাই শাহবাগের সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং তাৎপর্য। কেননা মানুষের এ জেগে ও জ্বলে উঠবার, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের, ক্ষোভ ও বিক্ষোভের কিংবা বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ইতিহাসে শাহবাগের নাম সংযুক্ত হবে নতুন উচ্চতায়। শাহবাগ যেমন জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্মের আবেগ, ক্ষোভ ও বিক্ষোভকে, তরুণ প্রজন্মের জ্বলে উঠবার এ প্রজ্জ্বল ইতিহাস বিপ্রতীপে জন্ম দিয়েছে শাহবাগকে।

'নতুন প্রজন্মের এ-জেগে উঠা' এবং 'শাহবাগের এই যে ইতিহাস হয়ে উঠা'– উভয় ঘটনাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিকে ভরকেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

অতএব তারুণ্যের এ জাগরণ কিংবা শাহবাগের এ ইতিহাস হয়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পরিশুদ্ধির প্রশ্ন্ও এখানে সমানভাবে জড়িত। যে জাগরণ কোনো জাতিকে ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি দেয়, মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত এজেন্ডার মীমাংসার প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিকে জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে ন্যায্যাতা দেয় এবং সব ধরনের রাজনৈতিক ছলচাতুরির ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকার দেশপ্রেমের দর্শনে গোটা দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে, সেটা তখন কেবল আর ইতিহাসের সীমায় আটকে থাকে না; সেটা হয়ে উঠে ইতিহাসের অধিক কিছু।

কালের ডাকে জন্ম নিয়েও সে ইতিহাস ভ্রমণ করে কালান্তরে। সমকালের রচনা হলেও সে ইতিহাস হয়ে উঠে মহাকালের প্রেরণা। তাই 'শাহবাগ' এখন আর কেবল সমকালের যন্ত্রণাজাত নয়, এটা এখন তারুণ্যের জেগে উঠবার মহাকালের মন্ত্রণা। 'শাহবাগ' এখন আর ইতিহাস নয়, ইতিহাসের ইতিহাস হয়ে উঠবার ইতিহাস।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, একাত্তর কেবল একটি শব্দ নয়। একাত্তর একটি রাষ্ট্রের জন্মকাল। পৃথিবীর মানচিত্রের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের নাম লিখিত হয় একাত্তরে। তবে সেটা অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক মানুষের জীবনের বিনিময়ে, অনেক মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে এবং লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করা গৌরব।

কিন্তু একাত্তরের সমস্ত গৌরবগাঁথার সঙ্গে লিখিত আছে রাজাকার-আলবদরের চরম কলঙ্কের লজ্জাও। বাংলাদেশে স্বাধীন হলেও একাত্তরের নানান প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়, মূলত এদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির চতুর এবং র্নিলজ্জ আপোষকামিতার জন্য। একাত্তরে মানবতাবিরোধী জঘন্য যুদ্ধাপরাধ করেও এদেশের রাজনীতিবিদদের সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের অনৈতিক প্রতিযোগিতার ফাঁক দিয়ে জামায়াত আদরে-আবদারে এদেশে রাজনৈতিক ময়দানে একটি জায়গা করে নিয়েছে।

এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মভীরুতাকে পুঁজি করে ইসলামের শামিয়ানা ব্যবহার করে জামায়াতের রাজনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে এবং ২০০১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মন্ত্রিত্ব পেয়ে জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়ে উঠে।

ফলে জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক অবস্থান থেকে কমজোর হয়ে পড়েছিল, তখন এদেশের নতুন প্রজন্মের তরুণ তুর্কীরা যুদ্ধাপরাধীদের এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তৈরি করেছিল 'গণজাগরণ মঞ্চ'।

তাই এ 'গণজাগরণ মঞ্চ'কে কেন্দ্র করে গোটা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেভাবে মানুষের স্বতঃষ্ফুর্ত সম্মিলন ও সংহতির জোয়ার উঠেছিল, তাতে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি নতুন পাটাতন তৈরির উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া গণজাগরণ মঞ্চ রাজনীতিতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের যে সৃজনশীল ভাষা হতে পারে, তার একটি সুষ্ঠু ধারারও সূত্রপাত করেছে, যা এদেশের মানুষ আগে কখনও দেখেনি।

দেশব্যাপী দাঁড়িয়ে একই সময়ে তিন মিনিট নিরবতা পালন, মোমবাতি জ্বালিয়ে সংহতি প্রকাশ, একাত্তরের শহীদদের উদ্দেশ্যে বেলুন উড়ানো, একাত্তরের চিঠি পাঠ কিংবা পতাকা মিছিল প্রভৃতি অত্যন্ত সৃজনশীল কর্মসূচির মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চ এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

শেষে এসে মূল যুক্তিতে ফিরে যাই। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও, তৎকালীন পূবর্ পাকিস্তান, যা আজকের বাংলাদেশ, পুনরায় পাকিস্তানের অধীনে এক নতুন ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয় নতুন করে মুক্তির সংগ্রাম।

তারপর ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯, এবং ১৯৭০-এর নতুন নতুন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের হাত ধরে আসে ১৯৭১। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্ বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন করে জন্মলাভ করে। কিন্তু ইতিহাসের পরম্পরায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের নতুন নতুন ইতিহাস সংযুক্ত হতে থাকে স্বাধীন দেশের সমকালীন ইতিহাসেও। তারই হাত ধরে আমরা পাই ১৯৯১-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান।

কিন্তু পরবর্তীতে দুই দশক হলেও ইতিহাসের পরম্পরায় আর কোনো গণজোয়ার কিংবা গণমানুষের সম্পৃক্ততায় আর কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস আমাদের রাজনৈতিক জীবনে আসেনি। তাই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম এবং তার সর্বজনীন চরিত্র ইতিহাসের পরম্পরায় একটি নতুন ঐতিহাসিক সংযুক্তি।

এটা কেবল ইতিহাসের একটি সফল এবং গৌরবান্বিত পরম্পরাই নয়, শাহবাগ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটা মহাকালে ইতিহাসে সমকালে অবদান। কেননা সমকালই নির্মাণ করে মহাকাল। তারও চেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, তিন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি শক্ত মেলবন্ধন তৈরি করা।

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করছি, কেননা আমি সবসময় মনে করি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কিছু সমষ্টিগত তাৎপর্য থাকে। ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি ১২ তারিখ বিকাল ৪টায় জার্মানির একটি শহরের একটি বাড়ির বারান্দায় যখন আমার ৫ বছরের একমাত্র মেয়ে মৃত্তিকা বাবার পাশে দাঁড়িয়ে মোমবাতি হাতে নিয়ে ঢাকার শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে– তখন আমি তার ভেতর দেশের প্রতি আমার ভালোবাসার প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, যা আমার বাবা আমার ভেতর সঞ্চারিত করেছিলেন।

এভাবেই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ তিন প্রজন্মের (আমার বাবাদের প্রজন্ম, একাত্তর-উত্তর আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের সন্তানরা যারা আগামীর প্রজন্ম) মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক চমৎকার সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।

এটাই শাহবাগ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: ভিজিটিং ফেলো, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স, ইংল্যান্ড ও সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।