দিলরুবা আহমেদের ‘কোকোনাট ককটেল’

দিলরুবা আহমেদদিলরুবা আহমেদ
Published : 5 August 2018, 01:15 PM
Updated : 5 August 2018, 01:15 PM


অলংকরণ: শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল

টগর নামটা শুনলেই আমার মনে হয় তুমি বুঝি টগবগ টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাচ্ছো। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এরকম মনে কেন হচ্ছে। তুমি কি ঘোড়া চালাতে জান। টেক্সাসে তো অনেক ঘোড়া আছে জেনেছিলাম।
টগর শুনে থাকলো। জবাব দিল না। ম্যাসেঞ্জার আবিস্কৃত হবার পর থেকে যত পরপুরুষ আছে সবার সুবিধা হয়েছে বড় বেশি। ফোন দেয়, যখন তখন। আলাপ চালাতে চায় বিরতিহীন ভাবে। তার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঐ লোকের দেশে এখন আলো। দিন। সে কথা বলবেই। বলেই যাবে। গত তিনদিনে তিনবার ফোন করেছে। প্রথম দিনেই তুমিতে নেমে গেছে বা উঠে এসেছে। নিচের তলার আন্টির ছাত্র ছিলেন। আন্টির ধারণা এই মানুষটা একজন অতি উত্তম এবং প্রয়োজনীয় পাত্র। ফেলে দিলে ভাংবে না। ছুড়ে মারলেও চৌচির হবে না। ফিরে ফিরে আসবে। অসাধারণ পাত্র। সেই অসাধারণ লা-জবাব পাত্র জানতে চাইছে বা চালিয়ে যাচ্ছে সেই একই ঘোড়া কথন,
 ওয়েস্টার্ন মুভিতে তো দেখতাম মরুভূমিতে বিশাল বিশাল ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছে হ্যাট পরে সবাই, টেক্সাস আরিজোনায়।
কিন্তু কোথায় ঘোড়া এখানে! টগর চোখ বড় করে ডানে বায়ে চেয়ে অবাক হবার ভান করে ভাব ধরে ভঙ্গীমা করলো। টেক্সাসের ডালাসের এই লোকালয়ের চারদিকে তো এত বছরেও ঘোড়ায় চড়ে কোন মানুষকে ঘুরতে দেখেনি সে। মানুষও যেমন না! একটা মুভিতে কি দেখলো ব্যাস ঐটাই বুকে আগলে জিন্দেগী পার করে দিলো।
 এখানে কোন ঘোড়া নেই। ঘোড়াবিহীন জীবন যাপন আমাদের। আপনি এলে না হয় একটা ঘোড়া কিনে দেব। টাট্টু ঘোড়া।
 না না , কি যে বল না। আমি ঘোড়ায় চড়তে জানি নাকি!
 শিখে আসবেন।
 ম্যাডাম যে বললেন গাড়ি চালাতে জানা মাস্ট।
 জী আন্টি আপনাকে ঠিকই বলেছেন। প্লেন চালাতে পারলে আরো ভাল। বাংলাদেশ থেকে একটা প্লেন নিয়ে সোজা আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের মাথায় নামতে পারতেন।
 তুমি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছো টগর।
 এখন রাতের তিনটা বাজে, আমি ঘুমাবো,ড্রিম দেখবো ।
 অবশ্যই অবশ্যই। গুড নাইট। কাল কথা হবে।


ফোনটা রেখে দিয়ে টগর চিৎপাট হয়ে শুয়ে থাকলো। নিচের তলার আন্টির উপর রাগ করবে না খুশী হবে বুঝতে পারছে না। আন্টি গত কয়েকদিন ধরে ধুনো তুলেছেন, আরো মোটা হয়ে যাওয়ার আগেই তার ২য় বিয়েটাও সেরে ফেলা উচিত। আন্টি যেন জানেই যে সে আরো মোটা হবে। শুধু তাই না বাংলাদেশ থেকে আসার সময়ই তিনি যেন জানতেন তার সাথেই দেখা হবে, আর তাই ব্যাগে করে কতগুলো যুবকের বায়োডাটা বয়ে নিয়ে এসেছেন, যারা কিনা সবাই এদেশীর বাঙালী মেয়ে বিয়ে করে প্রবাসী বা বিদেশী মানে আমেরিকান হতে চায়। সব কয়জনা-ই আন্টির ছাত্র ছিলেন। ছবিগুলো সব তাকে উল্টেপাল্টে দেখতেও হয়েছে, যদিও পছন্দ হয়নি একজনকেও, তারপরেও আম্মার যেহেতু এই ছেলেকে পছন্দ হয়েছে তাই এর সাথে চক্কর চালিয়ে দেখা হচ্ছে সুতা ছিড়ে কিনা এই বাড়ির সাথে। নতুন সংসারে উঠে গেলে কি কি সুবিধা হবে তারও বহু বর্ণনা দিয়েছেন আন্টি। আম্মাও। দুজনাই। টগর এখানেই থাকতে চায়। নাহলে কে দেখবে মাকে? ছোট ভাই দুটোকে মানুষ করতে হবে। কিন্তু সবাই চাচ্ছে তার একটা সংসার হোক। সংসার কথাটার মানেটা কি? মা ভাইদের নিয়ে থাকা কি সংসার করা হয় না! একটা লোককে বিয়ে করে তার সাথে জীবনে চলাটাই কি শুধু সংসার ধরা হয়! ধুর, হবে না ওইসব কিছুই আর তার জীবনে। মতিনের সাথে সব চলে গেছে। সব আবেগ ভেসে গেছেরে বাবা । সব উবে গেছে। উড়েও গেছে। ভাবে সে আজও আপন মনেই মতিন পারলো কিভাবে এভাবে ফেলে তাকে চলে যেতে। প্রায়ই, হঠাৎ হঠাৎ-ই, মনে পড়ে যায়। নিজেই তখন থমকে থাকে কিছুক্ষণ। চুপচাপ একাকী থাকে কিছুটা সময়। মা উকিঝুকি দিতেই থাকেন। বের করে আনতে চান তাকে বেদনা থেকে। তার মন কবে যে তৈরি হবে অন্য কিছুর জন্য কে জানে। আশ্চর্য্য ঐ যে তার বস পোকিলা কত সহজে সে মুভঅন করেছে। সিকিটরিটি গার্ড ইউসুফের সাথে এখন তো দহরম মহরম চূড়ান্ত। এই ক'দিনই। হাজার বছরে কাছে আসা যায় না। আর এ তো সপ্তাহও পার না করেই দু'জন এমন ভাব করছে যেন অনন্ত প্রেমের নায়ক নায়িকা। কে বলবে ঐ ইউসুফ দুদিন আগেও তার পিছু পিছু ঘুরতো। শুধু মা অখুশী হবেন বলে সে ফিরেও দেখেনি । আর পোকিলা আগের বরটা মুসলমান ছিল বলে কত কথা তখন বলেছিল যেন এই জীবনে সে আর মুসলমান বিয়ে করবে না। সব ভুলে তো আবার ঐ মুসলমানের ছেলেই পছন্দ হলো। দুজনই নাইজেরিয়ান, এতে হয়তো মিলেছে। অথচ সে কেন ভুলতে পারে না। উঠে দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। পার্কিং লটে এখনও পড়ে আছে মতিনের গাড়িটা। ভাইদের বলেছিল চালিয়ে চালিয়ে গাড়ি চালানোটা ভাল মতন প্রেকটিস করতে। বড়জন তো ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে গতকাল, আজ ওকে ঐ-ই গাড়ির চাবিটা দিয়ে দিয়েছে। সে চালাবে। পরান কিন্তু ঠিকই কেঁদে কেঁদে উঠছে মতিনের কথা ভেবে। যেদিন সে এই গাড়িটা কিনে এনে দিয়েছিল কত খুশিই না হয়েছিল মতিন। পুরাতন গাড়ি। মাত্র ৫০০০ ডলারে সে কিনে দিয়েছিল । বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছে তখন, নতুন বর। তাকে বিয়ে করায় এদেশে আসা। গাড়ী পেয়ে খুব খুশী হয়ে উঠেছিল বলেই তো সে ভেবেছিল। অথচ সে গাড়ীও এখন পরে আছে স্মৃতি হয়ে। মতিন চলে গেছে। মতিন্য চোরা ভাগছে। আন্টি অবশ্য বলছিলেন, ভাইকে দিচ্ছো কেন, আবার বিয়ে করলে কি আবার গাড়ি কিনবে নাকি নতুন জনের জন্য। টগর এখন নিজের মনেই হাসলো, মা আর আন্টির নতুন টারগেট তো ঘোড়া চায়। তার জন্য ঘোড়া কিনতে হবে। বারান্দার চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে টগর। কি নিরব চারদিক। শুধু ল্যাম্প পোস্টগুলোতে আলো জ্বলছে। আচ্ছা দূরে নিহাপুর এ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় কে দাড়ানো। হ্যাঁ নিহাপুই তো। এত রাতে! একা দাড়িয়ে। কত ভাল চাকুরি করে। কত পড়াশুনা জানা মেয়ে। তারপরও মনে হচ্ছে কি একা। আসলে একাই তো। না পাচ্ছে নিজের যোগ্যতার সাথে মিলিয়ে দেশী কাউকে খুজে পেতে নিয়ে বিয়ে করতে না বিদেশী বিয়ে করতে। তার নিজের হাল হয়েছে ওনার-ই মতন। কোথায় যে আছে কে তাদের জন্য একথা ভেবতে ভেবতেই টগর আকাশের দিকে তাকালো। দেখলো ছুটন্ততারা। এর কাছে যা চাওয়া যায় তাই নাকি পাওয়া যায়। কিন্তু কি চাইবে টগর তা ভাবতে ভাবতেই তারার পতন শেষ। চলে গেছে কোথাও। এত কিছু চাওয়ার আছে যে শুরুই আর করা গেল না ,কোনটা ফেলে কোনটার কথা বলবে ভাবতে ভাবতেই টাইমস আপ। বারান্দার সাথেই নিচে নামার সিড়ি। মনে হলো কি যেন নড়ে উঠলো নিচে। ওহ আল্লাহ আন্টি। এত রাতে নীচে একা বসে। যাবে কি নীচে! উপর থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। নিঝুম এই রাতে টগরের গলার শব্দই এখন মাইকের মতন শোনাবে। আন্টি উপরের দিকে ফিরে চেয়েছেন। এবার তো তাহলে তার নামা উচিত। সিড়ি বেয়ে নামতে যাবে মা এসে হাউজ কোটাটা এগিয়ে দিলেন। বললেন, ঠাণ্ডা পড়ছে। জ্বর আসবে।
 তুমি ঘুমাওনি।
: আমার কি আর এত সহজে ঘুম আসে।
 চল নিচে গিয়ে আন্টির সাথে বসি।
 না, উনি প্রফেসর মানুষ, তুই যা।
 আন্টি কিন্তু আমাদের সবার সাথে মিশে গেছেন। দেশের থেকে এসেছেন যে মাসও পুরেনি অথচ কি মিশে গেছেন। 
 কিন্তু বলেছেন তো, দেশে থাকলে অনেকের সাথেই মিশাতেন না। আমেরিকায় এসেছেন বলে মিশছেন।
 এভাবে নিচ্ছো কেন? এত কুটনামীর কি আছে।
 কি বললি আমি কুটনা?
 মা আই ডিড নট মিন দ্যাট। 
কে শোনে কার কথা। গট গট করে হেটে আম্মা ভিতরে চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, যখন আমি থাকবো না তখন বুঝবি। আমি মরলে বুঝবি।
কথায় কথায় মরার ধমক। একা থাকতে থাকতে মানুষ বুঝি এমন হয়ে যায়, অভিমানী। সবাই আছে শুধু তার স্বামী নেই তাতেই সে কতটা নিঃসঙ্গবোধ করে টগর সেটা নিজেকে দিয়ে বোঝে। একবার ভাবলো ভিতরে গিয়ে আম্মাকে বুঝায়, তারপরে ভাবলো এত রাতে হৈচৈ করে না আম্মা আবার পাড়া মাথায় তুলে। গিয়ে যে কি বলতে হবে তাও সে জানে না।
সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো। আন্টির ওখান থেকে তাদের ঝগড়া না শোনার কিছু নেই। আন্টি হেসে বললেন, মা মেয়ের ঝগড়া খুব কমন ব্যাপার। সবচেয়ে আপন আর কাছের জনের সাথেই তো আমরা লেগে যাই। দূরের কারও সাথে তো সারা জীবনেও লাগবে না। কথা কাটাকাটি হবে না। দেখ চাইলেও আমি ট্রাম্পের সাথে ঝগড়া করতে পারবো না।

টগর হাসে। 
 এখানে বসে কি কর।
 ঘুম আসছিল না। দেখলাম নিহাটাও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, তাই বসে বসে ওকে দেখছিলাম।
 ছেলের বৌ-টার জন্যও মন খারাপ লাগছে। এখনও বাড়ি ফেরেনি। বিদেশী মেয়ে,বুঝবেও না আমার টেনশন।
 কোথায় গেছে, বাপের বাড়ি।
 আরে না। আছে নাকি এদের বাপের বাড়ি। বাংলাদেশের মেয়েদের তো এটলিস্ট বাপের বাড়ি আছে, এদের তাও নেই।
 এরা নিজেদের বাড়ি নিজেরাই বানায়। সেটাই তো ভাল।
 কেউ নেই-দের দেশে সেটাই ভাল।
আমাদেরই বা এদেশে কে আছে।
বাহ টগর, তোমার তো সব আছে।
নেইও অনেক কিছু, তোমাদের জেনারেশন ভাবে একরকম, আমরা দেখি চারদিকের আমেরিকান জগৎ আরেক রকম। এটা এক ধরনের নাই। অনুভবের নাই। যে সংস্কৃতি সংস্কার অভিভাবকরা ধরে রাখতে চান তা নেই আমাদের আশেপাশে। চেনা ভাষা নেই, শব্দ নেই, দেশের পোষাক নেই, এদের সব পোষাক পরতে আমাদের দেওয়া হয় না। বয়ফ্রেন্ড নাকচ। বিয়ে তো দেশী মুসলমান ছাড়া যেন করাই যাবে না। খেতে গেলেও কতকি বাছতে হয়। আমি জীবনের প্রথম ষোল বছর দেশে কাটিয়ে এসেছিলাম বলে এই তেইশ বছর বয়সেও অনেক কিছুর দাম দেই। আর তোমার ঐ লা-জবাব পাত্রদের সাথে খেজুরা আলাপও তাই করি দেশী হিসাবে আরেক দেশী তোমার মান রাখতে। কিন্তু যাদের জনমই এই আমেরিকাতে তারা আর কতটুকুইবা দেশীয় ভাবধারার হতে পারে, বলতো!
আন্টি চেয়ে থাকলেন তার দিকে। তারপর বললেন,
ঐ ছেলেটা কি খুব খারাপ কিছু বলেছে তোমাকে? কাল তাহলে অরেক জনের সাথে কথা বলিয়ে দেবো , এই ছেলে বাদ। টগর হাসে। বলে, নাহ, একে আরেকটু দেখি।
কফির ঘ্রাণ। এত রাতে কফির ঘ্রাণ, চেয়ে দেখে আম্মা। কফি হাতে নামছেন। এগিয়ে দিয়ে পাশে বসলেন। হেসে বললেন, আমরা মাঝ রাতে পিকনিক করছি। একটু আগের রাগ চলে গেছে। সিঁড়িতে বসে থাকলো তারা তিনজন অনেক রাত পর্যন্ত। নিঃশব্দে। একসময় আন্টি গাইলেন,
তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া
সাথে সুর ধরলো শব্দ তুললো আম্মাও। টগর অবাক হয়ে গেল কেন এই জীবনে এই গানটা শুনেনি। এত সুন্দর একটা গান। শুধুই কি অচেনা রইলো, অন্য গোলার্ধে সে বড় হয়ে উঠেছে বলে।
না জেনেছে আমেরিকাকে, না চিনেছে বাংলাদেশকে। না হতে পেরেছে বাংলাদেশী, না আমেরিকান, না দেশী, না বিদেশী। টগরের ধারণা,এখানে বাংলাদেশের যারা বড় হচ্ছে একদিন বয়স থেকেই নারকেলের মতন তাদের উপরেরটা ব্রাউন অথচ ভিতরেরটা সাদা, আমেরিকানদের মতন সাদা। এ যেন কি টানাপোড়ন, কি এক টালমাটাল টানাটানি। ছাড়বো না, ধরবোও না, এ কি এক ভয়াল তমাল মিছিল, শোরগোল, একান্তে, নিরবে।