গোলাম মুরশিদ: পুরুষগুলো হাপিত্যেশ করতে থাকে একেকটা মেয়ের জন্য

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 12 Jan 2020, 03:21 PM
Updated : 12 Jan 2020, 03:21 PM


ছবি:রুম্মান তার্শফিক

লন্ডন-প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক, গবেষক, সংবাদ-উপস্থাপক এবং আভিধানিক। জন্ম ১৯৪০, বরিশালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। পি এইচ ডি-ঐতিহাসিক ডেভিড কফের তত্ত্বাবধানে। গবেষণার বিষয়, উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'দশক ধরে অধ্যাপনা। মাঝখানে দু'বছর কেটেছে মেলবোর্নে, শিবনারায়ণ রায়ের তত্ত্বাবধানে, পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণাকর্মে। ১৯৮৪ সাল থেকে লন্ডন-প্রবাসী। বেতার-সাংবাদিকতা এবং শিক্ষকতার অবসরে প্রধানত আঠারো শতকের বাংলা গদ্য এবং মাইকেল-জীবন নিয়ে গবেষণা। প্রধান নেশা গবেষণার-অতীতকে আবিষ্কারের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত বিদ্যাসাগর বক্তৃতামালার ওপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ: রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা (১৯৮১)। পিএইচডি, অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করে লেখা সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক (১৯৮৫)। মহিলাদের নিয়ে লেখা, 'Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization (১৯৮৩) (বাংলা অনুবাদ : সংকোচের বিহুলতা।[১৯৮৫]) এবং রাসাসুন্দরী থেকে রোকেয়া : নারীপ্রগতির একশো বছর (১৯৯৩)। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থ: কালান্তরে বাংলা গদ্য (১৯৯২), যখন পলাতক (১৯৯৩), আশার ছলনে ভুলি এবং বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার আদি-পর্ব (১৯৮৬), আঠারো শতকের গদ্য: ইতিহাস ও সংকলন, বিদ্রোহী রণক্লান্ত ইত্যাদি । প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২)। আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বক্তৃতা দান (১৯৯১-৯২)। ছদ্মনাম : হাসান মুরশিদ। এই নামে একটি উপন্যাসও লিখেছেন।
গত ২৫ ডিম্ববর (২০১৯) তার ধানমন্ডিস্থ বাসবভবনে তার সঙ্গে কবি প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিনের যে-দীর্ঘ
আলাপচারিতা হয় তারই শ্রুতিলিপি তৈরি করেছেন তরুণ গল্পকার সাব্বির জাদিদ। বি. স.

রাজু আলাউদ্দিন: মুরশিদ ভাই, এর আগেও আপনার সাথে কথা হয়েছে। সেগুলো তারপরেও যথেষ্ট নয়। এই জন্য যে, আপনার কর্মপরিধি অনেক বিষয় নিয়ে। ফলে অনেক বিষয়ই সেখানে আলোচিত হয়নি। যেমন, তার মধ্যে প্রধান বিষয় হচ্ছে, আপনি ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন প্রচুর। বাংলা গদ্য, বাংলা গদ্যের উত্থান, বাংলা গদ্যের বিকাশ–এগুলো নিয়ে আপনার একাধিক বই আছে। সম্ভবত সর্বশেষ বইটি হচ্ছে, আঠারো শতকে বাংলা গদ্য, ইতিহাস ও সংকলন। এই বইটিতে নমুনাগুলো আপনি দেখালেন। এর আগে আপনি কালান্তরে বাংলা গদ্য বইটিতে দেখিয়েছিলেন, ইংরেজরা কীভাবে এই ভাষাকে মোল্ট করছে। এই বইটির ধারণা মাথায় এল কেন? ওইটার সঙ্গেই তো থাকতে পারতো।
গোলাম মুরশিদ: আমি ওই বইটি করেছিলাম প্রধানত আইনের বই সম্পর্কিত যে সমস্ত বাংলা গদ্য পাওয়া গিয়েছিল, সেইগুলো অবলম্বন করে। আর এই বইটি হচ্ছে আঠারো শতকে বিভিন্ন ধরনের বাংলা গদ্য বিভিন্ন সোর্স থেকে যা পাওয়া যায়, সেইগুলোকে একত্রিত করেছি। শুধু তাই না, এখানে একটা জিনিস পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে, যেমন, ফ্রান্সের বিবলিওথেক নাসিওনাল থেকে পাওয়া বাংলা গদ্যের পাণ্ডুলিপি, সেগুলো আমি এরমধ্যে ইনক্লুড করেছি। যেমন, ওগাস্তুঁ ওসাঁর কাগজপত্র।
রাজু আলাউদ্দিন: যিনি একটা ডিকশনারি করেছিলেন?
গোলাম মুরশিদ: উনি কেবল একটা ডিকশনারি করেননি, এইটার মধ্যে আছে তার সংগৃহীত এবং তার ফরমায়েশে লিখিত আদর্শ চিঠিপত্র আর তিন-চারটা অভিধান। লিপিমালা বলে একটা বই আছে বাংলায়। ১৮০১ সালে বেরিয়েছিল। সেইটির লেখক ছিল রামরাম বসু। সেগুলো হচ্ছে আদর্শ চিঠি। এটাও আদর্শ চিঠি। তবে এটা হচ্ছে ১৭৮০ সালের দিকে রচিত। আরো পুরনো। এই চিঠিগুলো পরপর সাজানো। যেমন ছেলে বাবাকে লিখছে। বাবা ছেলেকে লিখছে। জামাই শ্বশুরকে লিখছে। শ্বশুর জামাইকে লিখছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই চিঠিগুলো লিখিত হয়েছে। আর এরমধ্যে আছে কতগুলো দলিল। যেগুলো বিভিন্নজনের সংগ্রহে ছিল। এবং যেগুলো পাওয়ার স্থান হলো ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান সাহেব পেয়েছিলেন তাঁতীদের চিঠি। দু বছরের চিঠি। ১৭৯০ সালের আর ১৭৯২ সালের। এই চিঠিগুলোর একটা সংকলন উনি প্রকাশ করেছেন। এবং সেখানটায় আমরা দেখতে পাই, তাঁতীরা ফ্যাক্টরিতে চিঠি লিখছে এবং ফ্যাক্টরি অফিস থেকে তাঁতীদের কাছে চিঠি লেখা হচ্ছে। এই চিঠিটা এক ধরনের রিসিটের মতো। অর্থাৎ বাঁদিকে একটা টেক্সট আছে, ডানদিকেও টেক্সট আছে। ছিঁড়ে মাঝখান থেকে এইটা পাঠানো হচ্ছে তাঁতীদের কাছে। তাঁতীরা উত্তর লিখছে। এখন এই জিনিসটা মূল্যবান। তার কারণ, এই গদ্য এর আগে কেউ খুঁজে পাননি। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতাটা হচ্ছে এখানটায়, যে, এই গদ্য শুধু তাঁতীদের গদ্য। তাতে আছে যে, এই থান কাপড় দিতে হবে। এই কোয়ালিটির কাপড় দিতে হবে। এই সমস্ত জিনিস নিয়ে একটা ফর্ম্যাটের মধ্যে পড়ে সেটা। আর আমি যেটা পেয়েছি, সেগুলো অনেক রকমের জিনিস। এবং অনেক বেশি জিনিস পেয়েছি। কাজেই সেদিক থেকে এই সংকলনটা আমি করলাম, যে, বিভিন্নজনের যে সমস্ত গদ্য তখন পাওয়া যায়, সেই গদ্যগুলোর সংকলন আমি করেছি। মেয়রস কোর্ট বলে কলকাতায় একটা কোর্ট ছিল, সেই মেয়রস কোর্ট ১৭২৬ সালে স্থাপিত হয়। সেখানে কতগুলো বাংলা ডকুমেন্টস পাওয়া যায়। আমি এগুলোর কতগুলো ডকুমেন্টস পেয়েছি। যেমন উইল করছে একজন। একজন নালিশ করছে–অমুক টাকা ধার নিয়ে আমাকে টাকা শোধ দেয়নি। এই জাতীয় সব জিনিস এরমধ্যে আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: তার মানে আমরা এই দাবি করতে পারি যে, এই বই হচ্ছে এখন পর্যন্ত প্রাচীনতম গদ্যের একটি সংকলন। এর আগের গদ্য পাওয়া যায় না। এই সূত্রে আমার একটি প্রশ্ন, সেটি হলো যে, ইংরেজদের রচিত যে গদ্যগুলোর নমুনা আমরা দেখতে পাই, সেই গদ্যের সঙ্গে এই গদ্যের কতটুকু মিল আছে? আপনি কোনো পার্থক্য অনুভব করেন কি না?


গোলাম মুরশিদ: অবশ্যই।
রাজু আলাউদ্দিন: সেই জায়গাটা আমি জানতে চাই।
গোলাম মুরশিদ: পার্থক্যটা এক কথায় আকাশ পাতাল। আমি কালান্তরে প্রথমে বাংলা গদ্যের যে নমুনা দিয়েছিলাম, সেই গদ্য ছিল ইংরেজির অনুবাদ করা। এবং আইনের বইয়ের অনুবাদ করা।
রাজু আলাউদ্দিন: তাহলে প্রথমত ওই টেক্সটটা ছিল অন্য একটি ভাষার। সেটাকে অনুবাদ করতে গিয়ে তারা এক ধরনের বাংলা নমুনা তৈরি করেছে।
গোলাম মুরশিদ: সেটা যখন করলাম, তখন দেখতে পাই আইনের ভাষা এমনিতে বেশ জটিল হয়, সেই জটিল ভাষা অনুবাদ করার মতো ক্ষমতা বাংলা গদ্যের তখন ছিল না। সুতরাং নতুন ধরনের এক গদ্য উদ্ভাবন করতে হয়েছে অনুবাদকদের। এই অনুবাদকরা কয়েকজন করে মুন্সি রাখতেন, সেই মুুন্সিরা একত্রিত করে অনুবাদ করত, তারপর একজনের কাছ থেকে হয়তো এই অনুবাদক শুনতেন যে, এইটার অর্থ কী। সে হয়তো ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল। তখন সে দেখল মূল টেক্সটের সঙ্গে মেলে কি না। এইভাবে করত।
রাজু আলাউদ্দিন: তাহলে এটা পুরোটাই কৃত্রিম একটা গদ্য।
গোলাম মুরশিদ: কৃত্রিম গদ্য। তার কারণ, এই গদ্যটায় যে সেনটেন্সগুলো লেখা হয়েছে, সেগুলো অনেক দীর্ঘ। কোনো কোনো সময় একটা বাক্যে একটা প্যারাগ্রাফ শেষ হয়েছে। আইনের বইতে যেমন হয়। আর পরিভাষার জন্য অনেক শব্দ তো নতুন তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি যখন ১৭৫৬ সালের গদ্য পাচ্ছি, তখন কিন্তু আমি সেই গদ্যে পাচ্ছি সেনটেন্সগুলো খুব ছোট ছোট। দাঁড়িকমা নেই। কিন্তু সেনটেন্সগুলো পড়লে পরে বোঝা যায় সেনটেন্সগুলো ছোট ছোট।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বোধহয় এরকম ছোট ছোট বাক্যের বা সুবোধ্য বাক্যের একটি নমুনা ওই বইটিতে দিয়েছিলেন। তৎকালীন এক মহারাজ একটা চিঠি লিখেছিলেন, মহারাজের নামটা ভুলে গেছি, সেই গদ্যের সাথে কিন্তু ইংরেজদের তৈরি গদ্যের মিল নেই।
গোলাম মুরশিদ: আপনি বলছেন হ্যালেডের কালেকশনের মধ্যে যে গল্পটা আছে, তার কথা। সেই গল্পটা হচ্ছে বেতালের গল্প। সেই গল্পটার কথা আপনি বলছেন। তো এমনিতে এই ছাপ্পান্ন সালের গদ্য, তখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি পরিভাষা। দুই নম্বর. তখন পর্যন্ত বাক্যগুলো কঠিন হয়নি। অরিজিনাল বাংলা। এটা ইংরেজির অনুবাদ নয়। সুতরাং সেই গদ্য আর যে-গদ্যটা পরবর্তীকালে অনূদিত হয়ে ছাপা হয়েছে বাংলায়, সেইটার গদ্য এক রকম নয়। এবং লক্ষ করি, আইনের বইগুলো যারা অনুবাদ করেছিলেন, যেমন, জোনাথান ডানকান এবং হেনরি পিটস ফরস্টার, এরা দুজনেই সজ্ঞানে সংস্কৃতধর্মী গদ্য লিখেছিলেন। অপর পক্ষে এটার মধ্যে যে মহুরিরা অনুবাদ করেছে, তারা বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের গদ্য লিখেছেন। কাজেই এই হচ্ছে পার্থক্য। বলা যেতে পারে ফরস্টার উইলিয়াম কেরিকে পথ দেখিয়েছিলেন সংস্কৃতধর্মী বাংলা গদ্য রচনা করার। উইলিয়াম কেরির অধীনে মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের আগ্রহবশত যে গদ্য লেখা হয়েছে, সেইটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্য।
রাজু আলাউদ্দিন: যে গদ্য আপনি পরে আবিষ্কার করলেন, এগুলো হচ্ছে বাংলা গদ্যের স্বাভাবিক চলন এবং বলন, যেগুলো এখনো পর্যন্ত আমরা অনুসরণ করে আসছি। সেটা নিশ্চয় ইংরেজদের প্রভাবিত গদ্য না। এই জায়গাটা নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই। এটা নিয়ে আমি ভেবেছি কিছুটা। সেটা হলো, অনেকেই বলে যে ইংরেজরা আমাদের গদ্য তৈরি করে দিয়ে গেছে, আসলে তারা তো তৈরি করেনি।
গোলাম মুরশিদ: এই গদ্যগুলো ইংরেজ সাহেবরা লেখেননি। এটা লিখেছেন তার অধীনে, সেই সাহেবদের অধীনে যে মুন্সিরা কাজ করত, তারা। কিন্তু পথ দেখিয়েছেন সাহেবরা।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু তারপরেও সেই মুন্সি এবং সাহেবদের রচিত যে গদ্য, সেগুলোর তো আমরা কখনো অনুসরণ করিনি।
গোলাম মুরশিদ: সেভাবে ঠিক বলা যাবে না। কারণ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যুগে প্রথম যে বাংলা গদ্য বেরোল, তার আগে বেরিয়েছিল আইনের বইগুলো, আইনের বইগুলো ১৮০৬ সাল পর্যন্ত বেরিয়েছে; আমি পঁচিশখানা বইয়ের উল্লেখ করেছি। সেই বইগুলো পথ দেখিয়েছে বাংলা গদ্যের। এই স্টাইল ধরে ফোর্ট উইলিয়ামের মুন্সিরা বই লিখেছেন। সেখানেও উইলিয়াম কেরি নির্দেশ দিচ্ছেন এইভাবে তোমরা বই লেখ। কাজেই যখন রাজা রামমোহন রায় গদ্য লিখলেন, তার সামনে একটাই নমুনা ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের। কাজেই তিনি যে প্রভাবিত হননি, এটা আমরা বলতে পারব না। হয়তো হয়েছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি বলতে চাচ্ছি সেই প্রভাবটা ইন্টেলেকচুয়াল একটা বলয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেটা তো আসলে সাধারণ মানুষের ভেতরে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি।


গোলাম মুরশিদ: প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু ইনডাইরেক্টলি প্রভাব পড়েছে। তার কারণ, যখন প্রথম পত্রিকা বেরোল ১৮১৮ সালে, তখন সেই পত্রিকাগুলোয় কী গদ্য লেখা হলো? সেই গদ্য লেখা হলো, যে গদ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে লেখা হয়েছিল। কোনো কোনো পণ্ডিতও কাজ করেছে পত্রিকায়। সেই পণ্ডিতরা এই গদ্য লিখলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে দুই রকম গদ্যই ছিল। সংস্কৃতধর্মী গদ্য এবং জনগণের মধ্যে স্বাভাবিক যে গদ্য চালু ছিল, সেই জাতীয় গদ্যের ছাপও তার মধ্যে থেকে গেল। এই জন্য ফোর্ট উইলিয়ামের বা আইনের বইয়ের অনুবাদের যে স্টাইল, এই স্টাইল শুধুমাত্র কৃত্রিম স্টাইল নয়, এরমধ্যে দুই রকম গদ্যেরই ছাপ রয়ে গেছে। কিন্তু অতীতে বাংলা গদ্য প্রথম দিকে যেভাবে লেখা হয়েছে, তখন লেখা হয়েছে ছোট বাক্যে, গ্রামীণ চালু শব্দে। 'যখন' বানান লেখা হয়েছে 'জ (জখন) দিয়ে। তার কারণ এটা বাংলা। এটা সংস্কৃত নয়। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন গদ্য সাধারণের মধ্যে লেখা শুরু হলো, তখন তারা সংস্কৃধর্মী গদ্যটাকেই বিশেষভাবে অনুকরণ করতে শুরু করল। এবং সেই গদ্যেও বানান জ দিয়ে লেখা হয়েছে। রামমোহন রায়ও ১৮২০ সালে জ দিয়ে লিখেছেন। অক্ষয়কুমার দত্ত যখন ১৮৪৩ সাল থেকে লেখা শুরু করলেন, তখন তিনি সংস্কৃতধর্মী গদ্য লিখেছেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃতধর্মী গদ্য লিখেছেন। কিন্তু তার সঙ্গে অক্ষয় দত্তের পার্থক্য এই, অক্ষয় দত্ত যে গদ্য লিখছেন, সেই গদ্য সংস্কৃতধর্মী; বিদ্যাসাগরও সংস্কৃতধর্মী গদ্যই লিখলেন বেতালের পঞ্চবিংশতিতে; কিন্তু গদ্যের যে ছন্দ, সেটা তিনি ধরতে পারলেন। গদ্যের ছন্দ কী, সেটা জানতে হবে। আবোলতাবোল করে যদি শব্দগুলো থাকে, তাহলে থামার মতো জায়গা পাওয়া যায় না। থামার মতো জায়গায় না পেলে শ্বাস ফুরিয়ে যাবে, তখন আর অর্থটা ধরতে পারব না। যেমন বিদ্যাসাগর প্রথম কমা (,) ব্যবহার করলেন। বেতাল তখন কহিল, মহারাজ, আপনি আদেশ করুন। তিন জায়গায় যদি কমা দিই, তাহলে পরিষ্কার পড়তে পারি। এইটাকে বলা শ্বাসযতি। শ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে অর্থ করা। আমার গদ্য যদি কখনো লক্ষ করেন, আমি কোনো নাম-করা লেখক না, দেখবেন, আমি সেনটেন্সগুলো সব সময় ছোট লিখি। এবং শব্দগুলো সহজ শব্দ দিয়ে লিখি। সঙ্গীতে আবদুল করিম খান বলে একজন মস্তবড় ওস্তাদ ছিলেন। তার গলা ছিল খুব মিহি এবং সুন্দর। আবদুল করিম যে গান গাইতেন, সে গান রিকশাঅলাও শুনত। তার কারণ সেটা সবাইকে রীচ করতে পারত। সবার কাছে পৌঁছাতে পারত। ফইয়াজ খান, তারই সঙ্গে একত্রে গান করেন, ফইয়াজ খানের গলা বাজখাঁয়ী গলা; সেই গলার এপ্রিশিয়েট করতে পারে, যারা গান জানে। যারা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বোঝে।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু দুজনই ওস্তাদ।
গোলাম মুরশিদ: দুজনই ওস্তাদ। আমি যখন বিবিসিতে কাজ করতে শুরু করি, তার আগে পর্যন্ত যে গদ্য লিখেছি, গদ্যের সৌন্দর্যের জন্য যে গদ্য লেখা হয়, সেটা ছিল সেই গদ্য। যেখানে ভাষাটাই লেখা হচ্ছে। ভাষার একটা আলাদা মর্যাদা দেয়া হচ্ছে সৌন্দর্যের জন্যে। আর পরবর্তী, আমি এখন যে গদ্য লিখি সে গদ্যটা আমি লিখি পড়া যায় কীভাবে। আমি কথাটা একটু বুঝিয়ে বলি।
রাজু আলাউদ্দিন: পাঠকবান্ধব।
গোলাম মুরশিদ: পাঠকবান্ধব এবং এইটা আমাকে বিবিসির একজন কর্মকর্তা বুঝিয়ে বললেন। তার নাম ডক্টর জিম নরিস। উনি ছিলেন ইস্টার্ন সেকশনের প্রধান। উনি আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো অধ্যাপক, তুমি কী ধরনের বাংলা গদ্য লেখ? তখন আমি বললাম, আমি মনে করি যে গদ্যের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। এবং সেই সৌন্দর্য আমি ধরতে চেষ্টা করি। উনি বললেন, সেটা কেন? তুমি কেন এমন গদ্য লেখ না, যে গদ্যটা ক্যান রিচ এভরিবডি! তাহলে তো তোমার বেশি পাঠক হবে। এই কথা বলায় আমি তখন সজ্ঞানে এমন গদ্য লেখা শুরু করলাম, যেটা সহজ। এবং ১৯৯০ নাগাদ এই গদ্য আমি আয়ত্ত করি। এবং সেই গদ্যে যে বই লিখলাম, সেই বই হচ্ছে যখন পলাতক। তিরানব্বই সালে বেরোল। সেই গদ্য আমার আগেকার গদ্যের সাথে মেলে না। এবং সেটাকে আরো সহজ করতে করতে এখন যে গদ্যে আমি লিখি, আমি দাবি করতে পারি, এই বাংলার পরিচিত প্রবন্ধকারদের কেউই এই গদ্যে লেখেন না। এবং এর দ্বারা যেটা আমার সুবিধা হয়েছে, সেটা হলো, অনেকেই আমার বই পড়ে। আমার মনে আছে, যখন প্রথম আলোয় বেরোচ্ছিল আমার বাংলা সংস্কৃতি বইটার একটা অংশবিশেষ, তখন আমাকে একাধিক লোক চিঠি লিখে জানিয়েছে, যে, আমি ইতিহাস ঘৃণা করি, ইতিহাস পড়ি না, কিন্তু আপনার এই লেখা পড়ছি। এবং আমার খুব ভালো লাগছে।
রাজু আলাউদ্দিন: বাংলা গদ্য নিয়ে, ভাষার সৌন্দর্য নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তাদের ব্যাপারে আপনার কী অভিমত? যেমন ধরা যাক, উদাহরণ দিয়েই বলি, বুদ্ধদেব বসুর গদ্যে জটিল বাক্য আছে, কমপ্লেক্স সেনটেন্স যেটাকে আমরা বলি, কমা কোলোন ড্যাশ ব্যবহার করে দীর্ঘ বাক্য– তার নমুনা আছে। সেই গদ্য আবার সুস্বাদু। এবং সুপাঠ্যও বটে।
গোলাম মুরশিদ: যদি বলতে চান, কার গদ্যের সাথে আমার গদ্যের মিল আছে তাহলে আমি বলব, বুদ্ধদেব বসু। কারণ বুদ্ধদেব বসু যেরকম ছোট ছোট বাক্যে কথা বলেন, বিশেষ করে গল্পে, সেই গদ্যটা আমি সজ্ঞানে না হলেও লিখতে গিয়ে আমি সেই গদ্যের কাছাকাছি চলে গিয়েছি। আমার একটা গল্পের কথা মনে আছে, যাতে বুদ্ধদেব বসু বলছেন : "কথাটা ও বলল না। বলতে পারল না। বলতে পারলেও বলত না।" তিনটি পরপর সেনটেন্স। এই যে জিনিসটা, এই জিনিসটা আমি বুদ্ধদেব বসু ছাড়া কারো গদ্যে দেখিনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ, যিনি বিভিন্ন ধরনের গদ্য লিখেছেন, সহজ থেকে শুরু করে অলংকৃত গদ্য, নানা রকমের গদ্য লিখেছেন, গদ্যকে সৌন্দর্য দান করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই রকম করে লেখেননি।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর যেটা আপনি বললেন, বুদ্ধদেব বসুর কথাসাহিত্যের ভাষাকে আপনি প্রয়োগ করছেন প্রবন্ধে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধের ভাষা আবার এ রকম না। তার প্রবন্ধের ভাষা জটিল বাক্যে তৈরি করা। জটিল হলেও সুবোধ্য, স্বচ্ছ।
গোলাম মুরশিদ: এটা আপনি ঠিক ধরেছেন। বুদ্ধদেব বসু খুবই সুন্দর গদ্য লিখেছেন; কিন্তু প্রবন্ধে লিখেছেন। সেই দিয়ে প্রবন্ধ তৈরি করেছেন। কিন্তু আমি আরেক কাঠি সামনে গেছি। আমি বলতে পারি, আমি খুব সহজ করে গদ্য লিখেছি, যেই গদ্য দিয়ে আমি প্রবন্ধ লিখি। এই গদ্য প্রায় গল্পের গদ্য। তো এই হচ্ছে বাংলা গদ্যের, বলা যেতে পারে আঠারো শতক থেকে একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা আবার আঠারো শতকের গদ্যের মতোন ছোট বাক্য লেখা শুরু করেছি।
রাজু আলাউদ্দিন: বিদ্যাসাগরকে কেন আপনার কাছে এতবেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? আপনি তাকে নিয়ে আস্ত একটি বই-ই লিখেছেন।


ছবি:আসিফ মাহমুদ অভি
গোলাম মুরশিদ: এই বইটি আমার একার লেখা বই নয়। এই বইটি কয়েকজনের প্রবন্ধ সংকলন। এইটা আমরা প্রকাশ করেছিলাম বিদ্যাসাগরের শতবর্ষ উপলক্ষে, ১৯৭০ সালে। এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে এই বই প্রকাশিত হয়। এই বইটির রিভিউ বাংলা সাময়িক প্রসঙ্গ বলে একটা পপুলার অনুষ্ঠান হতো, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে বিভিন্ন জিনিস রিভিউ করতেন, বিভিন্ন প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশ নিয়ে রিভিউ করতেন। একাত্তরের একুশে মার্চে এই বইটি সেই সংবাদ সাময়িকীতে প্রচার করল। সেই দিনই ভুট্টো বাংলাদেশে এসেছিলেন আলোচনা করার জন্য। সুতরাং সবাই শোনার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। এবং তারা শুনল এই বইয়ের আলোচনা। এবং সেই কারণে আমাকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরক্ষণে পালাতে হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চল্লিশ জনের তালিকা তৈরি হয়েছিল, শাস্তি দিতে হবে, তারমধ্যে এক নম্বর তালিকায় ছিল যাদের বধ করতে হবে, দশজন; সেই বধ করার তালিকায় দু নম্বরে আমার নাম ছিল। তার কারণ, আমি রাজনীতি করতাম না এবং এখনো আমি রাজনীতি করি না। কিন্তু লোকে ভাবল, কলকাতা রেডিও থেকে যে বইয়ের আলোচনা হয়েছে, সে বইয়ের মধ্যে নিশ্চয় রাজনীতি আছে। তো এই বইটির একটা বড় কৃতিত্ব হচ্ছে এই, যে, এই বইটি আমরা প্রকাশ করি এমন একটা সময়ে, যখন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগটাকে পাকিস্তানবিরোধী কাজ বলে মনে করা হতো। কাজেই সেই সময়ে এই বই বেরিয়েছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি তো দেখছি একেবারে অবধ্য! সেই কবে আপনাকে বধ করতে চেয়েছিল!
গোলাম মুরশিদ: হা হা হা। শেষ পর্যন্ত বধ করতে পারেনি। অবধ্যই রয়ে গেলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: মুরশিদ ভাই, আপনার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে রেনেসাঁস বাংলার রেনেসাঁস। ইতালিতে যে রেনেসাঁসের জন্ম হয়েছিল সেটা, এবং আমাদের এখানে যেটাকে রেনেসাঁস বলা হয়, এই দুটাকে এক সাথে এনেছেন, পাশাপাশি রেখেছেন। পাশাপাশি রাখতে গেলে স্বাভাবিকভাবে দুটোর পার্থক্য নজরে পড়বে। বাংলায় রেনেসাঁ তো ইউরোপের রেনেসাঁর মতো অতটা বড় আয়তনে বা অত গভীরতা নিয়ে আসেনি।
গোলাম মুরশিদ: তা আসেনি। আমাদের দেশে যে রেনেসাঁস হয়েছে, সেটা ভাষা-সাহিত্য নিয়ে। এর বাইরে কোথাও যায়নি। কিন্তু ইতালিতে রেনেসাঁস ভাষা-সাহিত্য নিয়ে এসেছে বটে, সেই সাথে চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য–এই তিনটাতে সবচে' বেশি এসছে। রেনেসাঁস সম্পর্কে প্রথম বই প্রকাশ করেন ইয়াকব বুর্কহার্ড। সেই বইটা বেরোয় ১৮৫৮ সালে। সেই বইয়ে উনি রেনেসাঁসের ইতিহাস লিখতে গিয়ে একটা জিনিস করেছিলেন, সেটা হচ্ছে, উনি রেনেসাঁস-পরবর্তী যে মূল্যবোধ, সেই মূল্যবোধকে রেনেসাঁসের বলে উনি মনে করেছেন। যেমন উনি লিবারেলইজম, যুক্তিবাদ এবং সেক্যুলারিজম এই তিনটা জিনিসকে উনি কিন্তু মনে করেছেন রেনেসাঁসের ফসল। কিন্তু তা নয়। এইগুলো হচ্ছে পরবর্তীকালে ইনলাইটেনমেন্ট বলে যে যুগটা হয়, সেই যুগের ফসল। তখন সেক্যুলারিজমের কথা উঠল। রেনেসাঁসের সময় সেক্যুলারিজমের কথা ওঠেনি। কেন ওঠেনি? তার কারণ, পোপরা করছেন এই জিনিস। মিকেল্যাঞ্জেলোকে দিয়ে এই যে ছবি করা হচ্ছে, কার নির্দেশে করা হচ্ছে? পোপের নির্দেশে করছেন। এখানে একটা জিনিস আপনাকে দেখাই। তাহলে হয়তো বুঝতে আপনাদের সুবিধা হবে। এখানে এইটার নাম হচ্ছে দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম। এই যে নগ্ন লোকটি, এ হচ্ছে অ্যাডম। আর এই যে জরায়ুর মধ্য থেকে ঈশ্বর তাকে জীবন দিচ্ছেন। জরায়ুর মধ্যে এইটা কীসের প্রতীক? সৃজনশীলতার প্রতীক। ওখান থেকেই মানুষ এবং প্রাণী সবকিছু আসছে। এইটা হচ্ছে এর বক্তব্য। এইটা করিয়েছেন পোপ। পোপ তো আর ধর্মবিরোধী জিনিস করবেন না।
রাজু আলাউদ্দিন: তখন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আসতেই পারে না।
গোলাম মুরশিদ: ধর্মনিরপেক্ষতা তখনো আসেনি। কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা এল? যেমন এই একটা ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি।


রাজু আলাউদ্দিন: বার্থ অব ভেনাস। ভেনাসের জন্ম।
গোলাম মুরশিদ: ভেনাস নামে এই ছবিটা। এইটার আগে প্রথম ভেনাসের ছবি পাচ্ছি আমরা পম্পাইতে। পম্পাই নগরী ধ্বংস হয়েছে ঊনআশি সালে। সেখানে যে ভেনাসকে পাওয়া যাচ্ছে, সেই ভেনাস একটি ঝিনুকের মধ্যে শায়িত। নগ্ন ভেনাস ঝিনুকের মধ্যে শায়িত। ঝিনুকটার একটা মাথা এরকম রয়েছে, আরেকটা মাথা এরকম। অন্য দেবতারা ফুঁ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ঝিনুকটাকে, সেটাও আছে পাশে। এরপর ১৪৮০ সালে এই ছবিটা আঁকলেন বোত্তিচেল্লি। বোত্তিচেল্লি আঁকতে গিয়ে উনি কীভাবে দেখাচ্ছেন–ঝিনুকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ভেনাস। এই যে ভেনাস দাঁড়িয়ে আছে ঝিনুকের মধ্যে। আর ওখান থেকে ফুঁ দিচ্ছে, এদিকটায় যাচ্ছে। সাগরের মধ্যে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে, কেমন? এই নারীটি দাঁড়িয়ে আছে ঝিনুকের মধ্যে। শুয়ে নেই। কাজেই পরিবর্তন হয়েছে। শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। এরপরের যে-ভেনাস, যেটা আমার বইয়ের মধ্যে ছবিটা আছে, সেটা এঁকেছেন তিশিয়ান। তিশিয়ানের ভেনাস কিরকম? ঝিনুকটা দূরে। ঝিনুকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে হাঁটু সমান পানির মধ্যে ভেনাস। ভেনাস এবার পানিতে নেমে গেছে। কেমন?


রাজু আলাউদ্দিন: মানে ঝিনুকমুক্ত হলো সে।
গোলাম মুরশিদ: ঝিনুক-মুক্ত হলো। এবং এবারের মেয়েটি একটু মোটাসোটা। কারণ, তিশিয়ানের বান্ধবী ছিল একটু মোটা। সে হচ্ছে তার মডেল। পরবর্তীতে ভেনাস হয়ে গেছে শুধুমাত্র একটা নাম। একটা প্রতীক। সৌন্দর্যের প্রতীক। আসলে এ ছবিতে ভেনাস টেনাস কিছু নেই। ঝিনুক টিনুক কোথাও নেই। এইটাকে বলে রেনেসাঁস।
রাজু আলাউদ্দিন: একটা বিবর্তন ঘটছে। দেখার ক্ষেত্রে, উপলব্ধির জায়গায় বিবর্তন ঘটছে। সেই অর্থে তো আসলে বাংলায় কোনো রেনেসাঁসই হয়নি।
গোলাম মুরশিদ: কোনো রেনেসাঁসই হয়নি বাংলায়। আমি যে জিনিসটা ছবি দিয়ে দেখালাম, এরকম কোনো বই প্রকাশিত হয়নি বাংলায়, যাতে ছবি দিয়ে দেখিয়েছে, যে, লুক, এটা ছিল ভেনাসের শুরুর পর্যায়। এরপর এটা ডেভেলপ করেছে। তারপর এটা ডেভেলপ করেছে। তারপর এটা ডেভেলপ করেছে। তারপর ইট বিকেইম জাস্ট আ সিম্বল অব বিউটি। এই জিনিস কোনো বইতে নেই। ইতালিয়ান রেনেসাঁসের আলোকে বাংলার রেনেসাঁস নামে বড় একটা বই আছে। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়ের। উনি আমার বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রিভিউ করেছেন। তার কারণ, উনি দেখতে পেয়েছেন, সত্যিই তো তাই! আমরা তো থিউরিটিকেল কথা বলেছি। আমরা তো ছবি দিয়ে দেখাতে পারিনি যে কোথায় কোথায় রেনেসাঁস হয়েছে। আমি এই জিনিসটা করেছি। সেই দিক থেকে এই বইটা ইউনিক।


রাজু আলাউদ্দিন: অবশ্যই। এবং অবসর পাবলিকেশন্স এটা বেরও করেছে অনেক যত্ন নিয়ে। কালারফুল। পুরো বইটাই মনে হচ্ছে ফোর কালারের। তো আপনার সুনির্দিষ্ট থিম ধরে ধরে লেখা বইয়ের বাইরেও আপনি নানান বিষয়ে লিখেছেন। নারী, ধর্ম, ভাষার নানা রকম ষড়যন্ত্র এবং বিকৃতি নিয়ে বই লিখেছেন।
গোলাম মুরশিদ: আমার প্রথম বই, যার জন্য আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলাম ১৯৮৩ সালে, সে বইটা ছিল Reluctant Debutante: Response of Bengali Women Modernization
রাজু আলাউদ্দিন: সংকোচের বিহ্বলতা
গোলাম মুরশিদ: সংকোচের বিহ্বলতা। সেই বইয়ে মুক্তি কী করে ঘটল ধীরে ধীরে, অথচ মেয়েরা এগিয়ে যেতে চায় না। পেছন দিক থেকে স্বামীরা ঠেলছে। কিন্তু মেয়েটি সামনে যেতে চায় না। সেই জন্য বলছি রিলাক্ট্যান্ট ডেবিউট্যান্ট। ডেবিউট্যান্ট হচ্ছে, যেখানে প্রথম বড়দের আসরে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। তাকে বলে ডেবিউট্যান্ট। সেজন্য ক্রিকেটে যে প্রথম খেলে তাকে বলে ডেবিউট্যান্ট। আর ডেব্যু হলো প্রথম যেদিন চান্স পেয়ে নামল। তো রিলাক্ট্যান্ট ডেবিউট্যান্ট নামটা ওই জন্য দেয়া।
রাজু আলাউদ্দিন: খুবই যথাযথ নাম।
গোলাম মুরশিদ: হ্যাঁ। যথাযথ নাম। নামের কথাটা বলায় আরেকটা কথা মনে পড়ছে। অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। আশার ছলনে ভুলি। তিনটিমাত্র শব্দ দিয়ে মাইকেলকে সামারাইস করেছি। মাইকেল যে আশার ছলনে ভুলি, কী ফল লভিনু হায়! মাইকেলের চিরদিনই উচ্চাশা ছিল, উচ্চাশা যখন ফলল না, তখন তিনি আফসোস করেছেন। সেই রকম নাম দিয়েছি আমি নজরুলের বইটার: বিদ্রোহী রণক্লান্ত। বিদ্রোহী বটে। শুরুতে বিদ্রোহী। কিন্তু রণক্লান্ত হয়ে রণেভঙ্গ দিয়েছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: নজরুল কি রণেভঙ্গ দিয়েছেন?
গোলাম মুরশিদ: অফকোর্স! তিনি গানের জগতে চলে গেলেন। আর একটা কবিতাও বেরোল না। সেইটিই তো রণেভঙ্গ।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু এটা তো একটা মাধ্যমের পরিবর্তন।
গোলাম মুরশিদ: মাধ্যমের পরিবর্তন…কিন্তু তিনি প্রেমের গান লিখছেন। ফরমায়েশি রচনা লিখছেন। বিদ্রোহী তো ফরমায়েশি লেখা লিখতে পারে না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি এটাকে রণেভঙ্গ হিসেবে দেখছেন?
গোলাম মুরশিদ: রণেভঙ্গই বলব। যে মুহূর্তে উনি টাকা নিয়ে গান লেখা শুরু করলেন, সেই মুহূর্তে তিনি বিদ্রোহ ছেড়ে দিয়ে রণেভঙ্গ দিলেন। এবং আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কী মনে করি নজরুলের জীবনীকার হিসেবে তার প্রতিভার কথা, তাহলে আমি বলব, তিনি, হি ওয়াজ আ বেটার আর্টিস্ট অব মিউজিক দেন আর্টিস্ট অব পোয়েট্রি।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো আবার তার কবিতার প্রশংসাও করেছেন।
গোলাম মুরশিদ: রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সেরকমের কবিতা কটা আছে?
রাজু আলাউদ্দিন: তবু এভাবে যদি বলি–যদিও গবেষক হিসেবে এগুলো আপনার নখদর্পণেই আছে–তবু মনে করিয়ে দেবার জন্য বলি, রবীন্দ্রনাথ তার নিজের সাঙ্গাতদেরকে বোঝাচ্ছেন, অসির ঝনঝনানি থাকলেই যে কবিতা হবে না তা তো নয়। কখনো কখনো তা মহাকবিতাও হতে পারে।
গোলাম মুরশিদ: এই কথাটা যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তার কোনো প্রমাণ নেই। বরং উনি নজরুলকে বলেছিলেন, তলোয়ার দিয়ে তুমি দাড়ি চাঁচ্ছ। অথচ তোমার জন্ম হয়েছে অনেক মহৎ কবিতা লেখার জন্যে। সর্বকালীন কবিতা লেখার জন্য। তুমি কিনা আজকের ছোটখাটো রাজনৈতিক কারণকে অবলম্বন করে কবিতা লিখছ।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বলতে চাচ্ছেন ওই বক্তব্যটার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই?
গোলাম মুরশিদ: এরকম কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এটা কোথাও লেখা নেই। রবীন্দ্রনাথ যেটা বলেছেন, যে কথা নজরুল নিজে লিখেছেন–তলোয়ার দিয়ে তুই দাড়ি চাঁচ্ছিস।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ। তা বলেছেন। কিন্তু আগের কথাটা অন্যের জবানিতে আছে।
গোলাম মুরশিদ: অন্যের জবানিতে থাকলে তা বিশ্বাস করা যায় না।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু ইতিহাস লিখতে গেলে তো অনেকের ওপর নির্ভরও করতে হয়।
গোলাম মুরশিদ: অনেকের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এ যুগে আমরা সিসি টিভির উপর নির্ভর করতে পারি। কিন্তু লোকজন যখন বলে, বানিয়ে বলে। নজরুল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে বলছে, গুরুজি, আপনাকে বধ করতে এসেছি। রাবিশ!


ছবি:আসিফ মাহমুদ অভি
রাজু আলাউদ্দিন: এইটা বলেননি উনি?
গোলাম মুরশিদ: কখ্খনো বলেননি। নজরুলের সেই সাহসও ছিল না এবং কোনদিন রবীন্দ্রনাথ দাওয়ায় বসে আছেন আর সে এসে চেঁচিয়ে বলল, আমি বধ করতে এসেছি।– এরকম কখনো ঘটেনি। যেসব ঘটনা কথিত আছে যে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের দেখা হয়েছে, সেই অকেশনে নজরুল যানইনি। নজরুল ধারেকাছে পৌঁছাননি। আপনি আমার বিদ্রোহী রণক্লান্ত বইটা পড়ে তারপর যদি আপনি আমার সঙ্গে আলোচনা করেন নজরুলকে নিয়ে, তাহলে আমি আপনাকে বলতে পারব। কিন্তু একটা সংক্ষিপ্ত কথা বলে রাখি, নজরুলের সত্যিকারের প্রতিভা হচ্ছে গানে। গানে তিনি সৃষ্টি করেছেন নতুন জিনিস। গানে তিনি পাগল ছিলেন। কবিতায় পাগল ছিলেন না। কবিত লিখেছেন ততদিন, ঢাকা থেকে ইলেকশনে হেরে গিয়ে প্রথম দিন যে কবিতাটা লিখলেন জ্বর আসতে আসতে–বাগিচার বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস না আজই দোল– সেইটা পর্যন্ত উনি ছিলেন বিদ্রোহী। তারপর আর বিদ্রোহী ছিলেন না। তারপর অর্থের জন্য গান শুরু করেছেন। এরপর গানের জন্য গান করেছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: এগুলো সবই সত্যি। কিন্তু আপনি যেটা বলছেন, একটা লোক যখন কিংবদন্তি হয়ে যায়, তাকে নিয়ে অনেক মিথ তৈরি হয়। কিন্তু মিথের সাথে তো অনেক সত্যও লুকিয়ে থাকে।
গোলাম মুরশিদ: সেটা আপনাকে দেখতে হবে। ক্রস-চেক করতে হবে। আপনাকে আমি ছোট্ট একটা জিনিস বলি। এটা আমার নজরুলের জীবনীর মধ্যে আছে। একজন লিখছেন, নজরুল ইলেকশনে লড়বেন বলে টাকা নিয়ে কলকাতায় বাজার টাজার করে তারপর ফিরে আসছেন কৃষ্ণনগরে। এরপর যে টাকাটা অবশিষ্ট ছিল সেই টাকাটা নিয়ে উনি কৃষ্ণনগর থেকে এসেছেন পূর্ববাংলায়, ক্যানভাস করতে। ওকে? আসল ঘটনাটি হচ্ছে, নজরুল ফিরেছেন যেই রাতে, সেই রাতে ফিরেছেন আবদুল হালীম এবং মুজফ্ফর আহমদকে নিয়ে। এই দুজনকে নিয়ে ফিরেছেন। আর ওই লোকটা বলছে, আমি তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম। এবং ওই টাকা দিয়ে বাজার করে তারপর উনি যাচ্ছেন কৃষ্ণনগরে।
রাজু আলাউদ্দিন: পুরো গল্পটাই বানিয়েছেন?
গোলাম মুরশিদ: গল্প বানিয়ে ছাড়লেন। কিন্তু সব মিথ্যে কথা। নজরুল এই দুজনকে নিয়ে কৃষ্ণনগরে গেলেন। রাতের বেলা তারা ছিলেন। পরের দিন সকাল বেলা আবদুল হালীমের ভাই মারা গেল, খবর পেলেন। তাড়াতাড়ি তারা ছুটলেন কলকাতার দিকে। এই হচ্ছে আসল ঘটনা। কাজেই সমস্ত কিংবদন্তি পরীক্ষা করে নিতে হবে সেকেন্ডারি সোর্স দিয়ে, যে, এটা সম্ভব না বলা। বলেছেন কি না? কার সামনে বলেছেন?
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার জন্য কেউ কি উনাকে নিয়ে গিয়েছিল?
গোলাম মুরশিদ: নিশ্চয় নিয়ে গেছে। কিন্তু কার কথা বলা হয় নিয়ে গেছেন?
রাজু আলাউদ্দিন: ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কথা বলা হয়।
গোলাম মুরশিদ: শহীদুল্লাহ নিয়ে গেছেন শান্তিনিকেতনে। সেইবারেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের দেখা হয়। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, পবিত্র মুখোপাধ্যায় নজরুলকে নিয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে। পবিত্রর আত্মজীবনী আমি পড়েছি। তার সঙ্গে নাহয় রবীন্দ্রনাথের চারবার দেখা হয়েছে, পাঁচবার দেখা হয়েছে। সে যদি নিয়ে গিয়ে থাকে নজরুলকে, তাহলে সে কথা আত্মজীবনীতে উল্লেখ করবে না?
রাজু আলাউদ্দিন: নেই?


ছবি:আসিফ মাহমুদ অভি
গোলাম মুরশিদ: নেই। দুই জায়গায় শুধু নজরুলের কথা আছে। দুই জায়গার কোথাও নেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। কাজেই মিথ মেলাতে হবে। আরেকটা জায়গা থেকে বলি। আমাদের নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম সাহেব, তিনি লিখছেন, যে, নজরুল সিলেটে গিয়ে আটকা পড়লেন। এবং সেখানে বসন্তে ভুগে তিনি ফিরলেন কৃষ্ণনগরে। আসল ঘটনা পাওয়া গেল কোথায়? দুটো জায়গা মেলালাম আমি। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, তিনি ওখানকার ছাত্র, তিনি লিখেছেন কোন সময় নজরুল এসেছেন কোন সময় আসেননি। তো আজরফ যেই সময়কার কথা লিখেছেন নজরুল আসেননি, সেই সময়ে রফিকুল ইসলাম সাহেব নজরুলের আসার কথা বলেছেন। আর যখন এসছেন, তখনকার কথা আজরফ বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। ফজলুল হককে নিয়ে তিনি গেছেন। ফজলুল হক এবং শহীদুল্লাহ। যদ্দুর মনে পড়ে শহীদুল্লাহই হবেন। আমার স্মৃতিভ্রম হতে পারে। তো এদের নিয়ে উনি (নজরুল) ওখানে গেছেন। কিছুদিন ছিলেন। প্রায় দু সপ্তাহর মতোন ছিলেন। আরো একটা জায়গায় পাচ্ছি, কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের বেঙ্গল কনফারেন্স হবে, সেই কনফারেন্সের প্রস্তুতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নজরুলের ওপর। নজরুল তখন মহাব্যস্ত। তার পক্ষে কি তখন সিলেটে গিয়ে দু সপ্তাহ থাকা সম্ভব? কাজেই দুটো সূত্র থেকে আমি সমর্থন পাচ্ছি, যে, উনি ওই সময় সিলেট যাননি। নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম সাহেবের কথাটা ঠিক না। কাজেই একজন যা লিখবেন, সেইটেই সত্য হবে–এমন কোনো কথা নেই।
রাজু আলাউদ্দিন: মানে ভেরিফাই করতে হবে। এইটেই তো আপনি বলতে চাচ্ছেন, তাই না? তো এরকম অসঙ্গতি কি প্রায় সবগুলো নজরুল জীবনীর মধ্যে কমবেশি আছে?
গোলাম মুরশিদ: সে অর্থে নজরুল জীবনী প্রথমে লিখেছেন মুজফ্ফর আহমদ। তারপরে লিখলাম আমি।
রাজু আলাউদ্দিন: তার মানে আপনার আগে মুজফ্ফর আহমদের ওই জীবনী গুরুত্বপূর্ণ?
গোলাম মুরশিদ: সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ। উনি প্রত্যেক সংস্করণে বদল করেছেন। আর বলছেন, আগের সংস্করণে আমি কথাটা এইভাবে বলেছিলাম, কিন্তু এখন অমুক পত্রিকার ফাইল দেখে দেখতে পাচ্ছি যে আমার কথাটা ঠিক ছিল না। এইভাবে উনি বহু জায়গায় এই কৈফিয়ত দিয়েছেন। এই হচ্ছে সত্যিকারের গবেষকের দৃষ্টি। যে গবেষক নির্দ্বিধায় নিজের ভুল স্বীকার করবেন। কিন্তু যে গবেষক লেখেন যে, নজরুল ওইদিন সকালবেলায় অমুক বাসায় চা খেয়েছিলেন, কেউ বলেন যে, তিনি সঙ্গে খেয়েছিলেন পরোটা আর গোস্ত; ফুটনোট আছে পরোটা আর গোস্তের; আর কেউ কেউ বলেন, না, তিনি খেয়েছিলেন ওমলেট আর পাউরুটি; ফুটনোট আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা হা।
গোলাম মুরশিদ: এই সবকে গবেষণা বলে না।
রাজু আলাউদ্দিন: গবেষণা তো ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে একটাকে নিতে হবে এবং সেটাকে স্টাবলিশড করতে হবে।
গোলাম মুরশিদ: আর না হলে আপনি বলবেন, যদ্দুর বোঝা যায় এইটা হয়েছিল। তবে এটা যে সত্য, এটা আমি হলফ করে বলছি না। এইভাবে উনি স্বীকার করবেন।
রাজু আলাউদ্দিন: এবার আমরা নারীতে আসি। নজরুল থেকে নারী।


ছবি:আসিফ মাহমুদ অভি
গোলাম মুরশিদ: নারী নিয়ে তো আমি বললাম। রিলাক্ট্যান্ড ডেবিউট্যান্ট আমার প্রথম বই নারী নিয়ে। তারপর দ্বিতীয় বই হচ্ছে এই বইটা: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া। এই বইটা এখন বড় আকারে বেরিয়েছে। এখন আমি একটা চ্যাপ্টার বেশি করেছি। এবং অন্য চ্যাপ্টারগুলো রিরাইট করে বড় করেছি। সেইটার নাম: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া: নারী প্রগতির একশ বছর। কিন্তু তারমধ্যে অনেক বেশি ম্যাটেরিয়াল আছে। এটা অবসর করেছে। আর আগেরটা বাংলা একাডেমি করেছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: এর বাইরেও তো নারীবিষয়ক কিছু রচনা ছিল।
গোলাম মুরশিদ: হ্যাঁ। নারী, ধর্ম, ইত্যাদি বইটা লিখেছি। এরমধ্যে আমি যেটা করেছি, নারী সম্পর্কে প্রথম লেখা শুরু করেছি, তারপর দেখিয়েছি নারীদের এক্সপ্লয়েট যারা করেছেন, তারা হলেন ধর্মের লোক। বিভিন্ন ধর্মে। শুধু যে একটা ধর্মে, এমন না। নানা ধর্মে নারীকে এক্সপ্লয়েট করেছে। যেমন, মনু তার সংহিতায় হিন্দু মেয়েদের কথা বলেছেন, যে, এরা হচ্ছে পাপের উৎস। এবং বলছেন যে, এরা কামের দিক থেকে পুরুষের আটগুণ। ভোজনে এরা ষোলগুণ। অমুকে বত্রিশ গুণ। এইরকম করে মেয়েদের হেয় করেছে। এটা সব ধর্মেই। ক্রিশ্চিয়ানিটিতে আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: কামের দিক থেকে নারী যে পুরুষের চেয়ে বেশি এটা তো গ্রিক মিথেও আমরা দেখি।
গোলাম মুরশিদ: গ্রিক মিথে দেখি। কিন্তু গ্রিক ধর্মে দেখি না। তবে বাস্তবে যদি আপনার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, নারীদের মধ্যে যৌনতা অনেক কম। পুরুষের থেকে কম। পুরুষগুলো হাপিত্যেশ করতে থাকে একেকটা মেয়ের জন্য।
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা হা।
গোলাম মুরশিদ: মেয়েরা তা করে না।
রাজু আলাউদ্দিন: মেয়েরা করে না– এর কারণ কি এটা নয়, যে, সমাজ নারীদেরকে হেয় করে রাখে? আপনি মনুর কথা বলছিলেন, এখন পর্যন্ত নারীরা দমিত, হয়তো তাদের মধ্যেও যৌনতা আছে, কিন্তু সামাজিক কারণে পারে না!
গোলাম মুরশিদ: সভ্যতার যে ইতিহাস, তাতে আমরা দেখি নারীরা পুরুষদের মতোন ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এবং নারীদের সম্পর্কে লেখার পর দেখালাম যে ধর্মে নারীদের স্থান কী। ধর্ম কীভাবে নারীদের অঙ্কন করেছে। সেই জন্য 'নারী, ধর্ম'। তারপর 'ইত্যাদি' হচ্ছে অন্য কয়েকটা বিষয়। কিছু প্রবন্ধ। এজন্য বইয়ের নাম দিয়েছি নারী, ধর্ম, ইত্যাদি। এবারে একটা বই আমি লিখলাম, এই বইটা এখনো প্রকাশিত হয়নি, এই বইটার নাম হচ্ছে: রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনা। এটার মধ্যে দেখিয়েছি, রবীন্দ্রনাথ এমন একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ, পৃথিবীতে তার মতো প্রতিভাবান লোক কখনো জন্মগ্রহণ করেনি, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা, যা ধরেছেন, সোনা হয়ে গেছে। বাংলা গদ্য থেকে শুরু করে যা কিছু ধরেছেন, সোনা ফলেছে। এই যে রবীন্দ্রনাথ, এই রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত স্ববিরোধিতার মধ্যে পড়েছেন নারীদের নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে নারীদের প্রশংসা করেছেন, কী বলেছেন? নারীদের প্রেম, নারীদের সেবা, নারীদের সহিষ্ণুতা, নারীদের সেবাপরায়ণতা, নারীদের বিচিত্র গুণ, নারীরা রান্না করে খাওয়াবে, নারীরা বাচ্চার লালন করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ এই গুণগুলোরই প্রশংসা করেছেন।


ছবি:আসিফ মাহমুদ অভি
রাজু আলাউদ্দিন: তার মানে এই হচ্ছে তার কাছে নারী?
গোলাম মুরশিদ: নারী। কিন্তু যেখানটায় উনি নারীদের শ্রেষ্ঠ করে অঙ্কন করেছেন, যেখানকার নারীদের উনি সত্যিকারের বিদ্রোহিনী করে অঙ্কন করেছেন, যেমন, বিমলা; যেমন, চিত্রাঙ্গদা–এগুলো হচ্ছে সৃজনশীল রচনায়। কাজেই তার মধ্যে আমরা স্ববিরোধ দেখতে পাই। স্ববিরোধ একদিকে মননশীল রচনায় নারীদেরকে হেয় করা, বা নারীদের তোয়াজ করা, যে, তোমরা খুব ভালো লক্ষ্মী বউ; আবার সৃজনশীল রচনায় নারীদের উনি বড় করছেন। এই যে স্ববিরোধ, এই স্ববিরোধটা হচ্ছে মূল বিষয়বস্তু আমার বইয়ের।
রাজু আলাউদ্দিন: মননশীল রচনায় তার যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললেন আপনি, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে সাক্ষাতের পরেও কি সেটা অব্যাহত ছিল নাকি বদলে গেছে?
গোলাম মুরশিদ: ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তো তার স্বপ্নের জগৎ। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তো তার সৃজনশীলতার জগৎ। এটা নিয়ে তার যে মস্তবড় কোনো পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়নি। কারণ, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে তার ১৯২৪ সালে দেখা। আর ১৯২৫ সালের তার বেশ কয়েকটা প্রবন্ধ আছে নারীদের নিয়ে, সেখানে আমরা এই স্ববিরোধ পুরোপুরি লক্ষ করি।
রাজু আলাউদ্দিন: তারমানে ভিক্টোরিয়া উনার খুব একটা বদল ঘটাতে পারেননি। কিন্তু …
গোলাম মুরশিদ: ভিক্টোরিয়া নিজেও তখন অন্য রকম নারী ছিলেন। ভিক্টোরিয়া নিজেও তখন বিদ্রোহিনী ছিলেন না। ১৯২৪ সালে।
রাজু আলাউদ্দিন: না না। তখনো হয়তো তিনি পাঠিকা ছিলেন। বা লেখালেখি শুরু করছেন মাত্র। কিন্তু ওই বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ ঘটেনি।
গোলাম মুরশিদ: এবং যখন উনি লিখছেন আত্মজীবনী, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বহু বছর পরে, রবীন্দ্রনাথ তার স্তনে আলতো করে হাত দিয়েছিলেন। রাবিশ! তুমি লিখলে না কেন তার জীবদ্দশাতে! তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম কার কথা সত্য।
রাজু আলাউদ্দিন: এটাও আবার শুধু ফরাসি সংস্করণে আছে, স্প্যানিশ সংস্করণে সেটা নেই।
গোলাম মুরশিদ: এবং একটা জিনিস, রবীন্দ্রনাথ বলেন, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে। অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন..আমার আলিঙ্গন আমি তোমাকে দিতে চাই, তোমার সমস্ত শরীর জুড়ে আমি আলিঙ্গন দিতে চাই; কিন্তু অঙ্গবিহীন! এতবড় কথা যার, পিউরিটিয়ান রবীন্দ্রনাথ, ব্রাহ্মরুচির রবীন্দ্রনাথ, ভিক্টোরিয় রুচির রবীন্দ্রনাথ– সেই রবীন্দ্রনাথ একটা মেয়ের স্তনে হাত দেবে! একটা কথা হলো!
রাজু আলাউদ্দিন: তবে এটাও তো ঠিক মুরশিদ ভাই, মানুষ তো একেবারে গণিতের মতো না।
গোলাম মুরশিদ: না। রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। এই মেয়েটি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে সম্ভব! তার মিথ্যে কথা তো এখানেই ধরা পড়ে। আপনি এইভাবে বসে আছেন। আপনার পেছনে একটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি কীভাবে মাথার পেছনে চোখ না থাকলে নিপুণভাবে আপনার একটা হাত একটা স্তনের ওপর রাখবেন!
রাজু আলাউদ্দিন: এটা সম্ভব না।
গোলাম মুরশিদ: তাহলে? মিথ্যে কথা তো তিনি নিজেই সাক্ষী দিচ্ছেন। উনি বলেছেন আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।
রাজু আলাউদ্দিন: কেতকী কুশারী ডাইসন কী বলেন এই বিষয়ে? উনি তো রবীন্দ্রনাথ এবং ওকাম্পোকে নিয়ে কাজ করেছেন।
গোলাম মুরশিদ: কেতকীর বই থেকেই তো এই কথাটা পড়েছি। এই ঘটনাটা আছে কেতকীর বইতে।
রাজু আলাউদ্দিন: কেতকী কিন্তু এই ঘটনাকে অস্বীকার করেননি।
গোলাম মুরশিদ: উনি অস্বীকার করেননি। উনি ওকাম্পোর বয়ান উল্লেখ করেছেন। এই যে বললাম, এই ঘটনা ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনেক বছর পর উল্লেখ করেছেন এবং এটা হতে পারে না, এটা আমি বললাম। অন্য কেউ বলেননি। তো যাই হোক, এই বইয়ে আমি আরেকটা প্রবন্ধ জুড়ে দিয়েছি। সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের প্রেম। সেটাকেও আমি নতুন দৃষ্টি থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা কাঙালপনা ছিল, স্নেহের জন্যে। কারণ তিনি মায়ের ভালোবাসা পাননি। যার কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছিলেন, কাদম্বরী দেবী, তার থেকে দু বছরের বড়, তার কাছেই তিনি সাহিত্যের হাতেখড়ি নিয়েছিলেন, সেই কাদম্বরী দেবী আবার আত্মহত্যা করলেন। কাজেই দুদিক থেকেই ফাঁকা হয়ে গেল। এবং সেখানে যে স্ত্রী এলেন–এই একটা কথা আমি নতুন করে বলেছি–ভবতারিণী দেবীকে উনি কীভাবে বিয়ে করলেন! ভবতারিণী দেবী হচ্ছে গ্রামের একটি অশিক্ষিত মেয়ে। তাকে কী করে উনার মতো একজন সফিসটেকেটেড কবি, অতি সুদর্শন, অতি অভিজাত, তার মতো একজন মানুষ কী করে বিয়ে করলেন!
রাজু আলাউদ্দিন: তিনি তো বোধহয় নায়েবের মেয়ে ছিলেন?
গোলাম মুরশিদ: নায়েবও না। বাজার সরকারের মেয়ে ছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি গেছি ওই বাড়িতে।


ছবি:রুম্মান তার্শফিক
গোলাম মুরশিদ: দক্ষিণডিহি।
রাজু আলাউদ্দিন: দক্ষিণডিহি।
গোলাম মুরশিদ: এরপর এইটার আমি একটা ব্যাখ্যা দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ যে নিজের চোখে দেখেই মেয়েটিকে বিয়ে করলেন, তার কারণ হচ্ছে, তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, কাদম্বরী যদি আমাদের পরিবেশে এসে কাদম্বরী হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে ভবতারিণী কেন কাদম্বরী হবেন না!
রাজু আলাউদ্দিন: তিনি কি ভবতারিণীকে কাদম্বরী করতে চেয়েছিলেন?
গোলাম মুরশিদ: চেয়েছিলেন। লরেটতে পাঠিয়েছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কিন্তু আনফরচুনেটলি, সবাই কাদম্বরী হয় না। এনিওয়ে, আমি তার প্রেমের একটা নতুন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি। প্রেমের সড়কটা বোঝাবার চেষ্টা করেছি, যে, তিনি আজকালকার ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের মতোন প্রেমের অর্থ করতেন না, যে, ঝট করে শুয়ে পড়ো। তিনি প্রেমকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতেন। তার প্রেম অতিসূক্ষ্ম প্রেম। এটা আমি জুড়ে দিয়েছি এই বইয়ের মধ্যে। এরমধ্যে আরো একটা প্রবন্ধ আছে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ, স্বরাজ, স্বাধীনতা। স্বাধীনতা বলতে রবীন্দ্রনাথ কক্ষণো বোঝাননি যে ইংরেজ চলে যাওয়ার মানে হচ্ছে স্বাধীনতা। কেউ খুঁজে দিতে পারবে না, যে, কোনো জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ইংরেজরা চলে যাক, আমাদের দেশ আমরা শাসন করব।
রাজু আলাউদ্দিন: এরকম কোনো বক্তব্য তার নেই।
গোলাম মুরশিদ: অথচ তিনি দেশকে এত ভালোবাসতেন! এবং ছোট ইংরেজকে এত করে গাল দিয়েছেন, এত নির্মম ভাষায় আক্রমণ করেছেন, গান্ধীজি কিচ্ছু করতে পারেননি; কিন্তু উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে স্যার উপাধি বর্জন করেছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: তার মানে দেশপ্রেমে কোনো ঘাটতি ছিল না।
গোলাম মুরশিদ: তার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তিনি স্বাধীনতার অন্য অর্থ করতেন। তিনি বলতেন, স্বরাজ এবং স্বাধীনতা এক নয়। স্বরাজ মানে নিজেদের অটোনামি। আমরা ইংরেজদের অধীনে থাকব কিন্তু নিজেরা শাসন করব। স্বাধীনতা তা না। স্বাধীনতা হচ্ছে স্বনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ। যে সমাজ ভারতবর্ষে চিরদিন ছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: ভারতবর্ষে চিরদিন ছিল বলতে আপনি বোঝাচ্ছেন ইংরেজপূর্ব ভারতবর্ষে চিরদিন ছিল?
গোলাম মুরশিদ: ইংরেজপূর্ব ভারতবর্ষে। তার কারণ জমিদার ছিল, জমিদার যে টাকাটা পেত শোষণ করে, সে টাকাটা বেশিরভাগ আবার গ্রামেই ব্যয় করত। রাস্তা করত। স্কুল করত। কিন্তু ইংরেজ আমলে যেটা হলো, জমিদাররা সব চলে গেল কলকাতায়। ইংরেজ আমলে সরকার বলে একটা জিনিস এল। ইন প্লেস অব জমিদার। এবং জমিদার থাকে কোথায়? জমিদার থাকে কলকাতায়। খাজনার টাকাটা যায় কলকাতায়। ব্যয় হয় কলকাতায়। ফলে গ্রামে যে এক সময় ব্যয় হতো, সেই ব্যয়টা আর হলো না। গ্রামের কাউকে যে জমিদার দয়া করবেন, সেই দয়ার জায়গাটা আর থাকল না। ইংরেজ আসায় সেটা ধ্বসে গেল। সুতরাং এটাকে স্বাধীনতা বলে না। স্বাধীনতা হলো সেই সমাজ, যেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং স্বনির্ভরতা আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি রবীন্দ্রনাথের নারীদের কথা বলছিলেন। আমরা তো সেই সময় থেকে বহু বছর পেরিয়ে এলাম। এত বছর পরে আমাদের এখানকার নারীরা শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, পেশায় অংশগ্রহণ করছে–এরপরও কি একজন নারী সামগ্রিক সত্তার প্রকাশ নিয়ে দাঁড়াতে পারছে? যদিও আমাদের এখানে বহু বছর ধরে নারীরাই প্রধানমন্ত্রী।
গোলাম মুরশিদ: আমাদের এখানে নারীর ক্ষমতায়ন অনেকটাই হয়েছে। কিন্তু কোথায় হয়েছে? রাজনীতিতে। রাজনীতিতে নারীরা এমপি আছেন, মন্ত্রী আছেন, প্রধানমন্ত্রী আছেন। হয়তো এক সময় রাষ্ট্রপতি থাকবেন নারী। এ রকম করে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে ওখানটায়।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু সমাজে নাই।
গোলাম মুরশিদ: সমাজে কোথাও নাই নারীর ক্ষমতা। যেমন, আপনি দেখতে পারেন, একজন নারী সেক্রেটারি আদেশ দিয়ে গেলেন যে এটা করো। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পুরুষরা বলবে–'এ্যাহ'! একটা খারাপ শব্দ উচ্চারণ করে বলবে–'একটা হুকুম দিয়ে গেল'। কিন্তু সামনে বসে স্যার স্যার করছে। আবার নারীদেরও স্যার বলতে হবে।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা আমি বুঝি না স্যার কেন বলতে হয়!
গোলাম মুরশিদ: বিধাতা জানেন।


ছবি:রুম্মান তার্শফিক
রাজু আলাউদ্দিন: কে জানে? বিধাতা? হাহাহা।
গোলাম মুরশিদ: যাকগে। রাজনীতি ছাড়াও অন্য ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতা বেড়েছে। নারীরা ডাক্তার। নারীরা পাইলট। নারীরা ব্যবসায়ী। এইটাই ছিল লাস্ট ফ্রন্টিয়ার নারীদের জন্য। ব্যবসা করা। নারীদের অনেক ক্ষমতা হয়েছে। নারীরা এখন ছোট পদ থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় পদ অধিকার করেছে। নারীদের সবচেয়ে বড় মুক্তি যেখানটায় এসছে, পরিবারে ভয়েস। সিদ্ধান্ত গ্রহণে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এখানে সবার আগে নাম করতে হবে, যারা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে। ইন্ডাস্ট্রিতে চল্লিশ লাখ নারী কাজ করে। এবং তারা স্বামীর মার খায় না। শৃঙ্খলিত না। সুতরাং এখানটায়, আমার ধারণা, নারীদের যথেষ্ট ক্ষমতায়ন হয়েছে। কিন্তু নারীদের যেখানটায় পুরোপুরি স্বাধীনতা আসেনি, সেটা পরিবারের ভেতরে।
রাজু আলাউদ্দিন: সামগ্রিকভাবে আসলে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলায়নি। নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে, কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। সেগুলো আমরা পরিবহন বা পাবলিক প্লেসে গেলে দেখতে পাই। তো এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলের জন্য কি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দরকার?
গোলাম মুরশিদ: পরিবর্তন একদিন হবে। কিন্তু যে মেয়েগুলো ছাড়া পেয়েছে বাইরে, মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের আবার 'অভ্যন্তরে' চলে যাওয়ার একটা আশঙ্কাও আমি দেখতে পাচ্ছি।
রাজু আলাউদ্দিন: কী রকম সেটা?
গোলাম মুরশিদ: সেটা হচ্ছে নারীদের একদম নতুন সাজে সাজিয়ে রান্না ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।
রাজু আলাউদ্দিন: কী রকম সেটা? এটা তো আলঙ্কারিকভাবে বললেন।
গোলাম মুরশিদ: আলঙ্কারিকভাবে না। আমি সত্যিকারভাবে বললাম। নারীদের হিজাব পরিয়ে, বোরকা পরিয়ে আপদমস্তক ঢেকে আবার তাদেরকে ঘরের মধ্যে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক।
রাজু আলাউদ্দিন: সেটা অবশ্য ঠিক। এটা ঘটছে। এটার পেছনে সংস্কৃতির ধর্মায়ণ মূল কারণ। আপনি কী বলেন?
গোলাম মুরশিদ: ধর্ম নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।
রাজু আলাউদ্দিন: ধর্ম নিয়ে বলতে হবে না। একজন সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে যেটুকু আপনার বলার দরকার সেটুকু বলেন।
গোলাম মুরশিদ: না। সেটুকুও আমি বলব না। ধর্ম সম্পর্কে কোনো উক্তিই আমি করতে চাই না।
রাজু আলাউদ্দিন: ধর্ম কি একটা উপাদান হিসেবে কাজ করছে? প্রধান উপাদান?
গোলাম মুরশিদ: উপাদান হিসেবে কাজ করছে। মেয়েরা এগিয়েছিল, মেয়েরা সেই অগ্রগতি বজায় রাখতে পারবে কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
রাজু আলাউদ্দিন: এর পেছনে একটা কারণ থাকতে পারে। অনেক বাবা-মা তার মেয়েকে শেখায়, তুমি নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী হও, তুমি বড় কিছু করো, মুক্ত পৃথিবী দেখতে হবে; কিন্তু তার ছেলে সন্তানকে শেখানো হয় না, তুমি একটা মুক্ত মেয়ের সাথে কীভাবে ব্যবহার করবে। এটা শেখানো হয় না।
গোলাম মুরশিদ: এটা একদম খাঁটি কথা। এটা পুরুষপ্রধান সমাজের একটা ফল। পুরুষপ্রধান সমাজে পুরুষকেই মনে করা হয় কর্তা। নারীরা যে কর্তা হতে পারে কর্ত্রী না হয়ে, এ কথাটা কখনো শেখানো হয় না। এবং পুরুষপ্রধান সমাজে নারীদের দমন করার বড় হাতিয়ারই হচ্ছে ধর্ম যেটা আমি ওই বই উপলক্ষে বলেছি। মনু এমন বিধান দিলেন, নারীরা কক্ষনো ভালো কিছু নয়। আবার তাদের সম্পর্কে ঘৃণা, তাদেরকে মূল্য না দেয়া, তাদেরকে মনে করা হচ্ছে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যা। পুত্র জন্ম দেয়ার জন্য যার আগমন। তাও মেয়ে জন্ম দেয়ার জন্য না; পুত্র জন্ম দিতে হবে।
রাজু আলাউদ্দিন: কী অদ্ভুত, না? কিন্তু মেয়ে যদি জন্ম না দেয়, এরপরে কী হবে? সারা পৃথিবী তো পুরুষে কিলবিল করবে।
গোলাম মুরশিদ: সে জন্যই বোঝা যায়, মনু যে কথাটা বলেছেন, সে কথাটা মিথ্যা। প্রকৃতি যে কথা বলছে, সেটা সত্য। প্রকৃতি ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্ম দেয়।


ছবি:রুম্মান তার্শফিক
রাজু আলাউদ্দিন: ভারতে যে সতীদাহ প্রথা ছিল, এটা কি একদম মনুর সময় থেকেই ছিল?
গোলাম মুরশিদ: এটা ঠিক বলতে পারব না আমি। তবে সতীদাহ প্রথা কখনোই খুব পপুলার ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: তাই! মানে গোটা ভারতবর্ষে এটা ছিল না?
গোলাম মুরশিদ: এটা কখনোই গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে ছিল না। এবং এই জিনিসটা সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশে চালু ছিল। তা না হলে মেয়ে পাওয়া যেত না। তা না হলে বেশিরভাগ মেয়েই এভাবে মারা যেত। কারণ বাল্যবিবাহ হতো। মেয়েদের বয়স যখন দশ তখন স্বামীর বয়স পঁচিশ/ত্রিশ, স্বামী মরে যাচ্ছে আগে আগে। আর তখন উৎপাদন ক্ষমতাবিশিষ্ট মেয়েদেরও চলে যেতে হতো চিতায়। কিন্তু সেটা তো হয়নি।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের এলাকাতেই ছিল?
গোলাম মুরশিদ: পশ্চিমবঙ্গে এটা বেশ ছিল। এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গাতে দু একটা কেইস ঘটে।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, সেটা তো একসেপশন হিসেবে ঘটে। কিন্তু তখন কি ব্যাপক হারে ছিল?
গোলাম মুরশিদ: ব্যাপক হারে কখনো ছিল না। রামমোহন এটা করলেন, কেননা কুলিন ব্রাহ্মনদের মধ্যে এটা কিছুটা ছিল। সে জন্য রামমোহন এটা নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু এটা কোনো জনপ্রিয় সংস্কার ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বাংলাভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। এর সঙ্গে রাজনীতিও নিশ্চয় আছে। কারণ সংস্কৃতি তো রাজনীতির বাইরে নয়। ভারতবর্ষের রাজনীতিরই ফল এখন আমরা। ভারতবর্ষের এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা এবং ধারাবাহিকতা সম্পর্কে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
গোলাম মুরশিদ: এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই না। কিন্তু আমি সংক্ষেপে যেটা বলতে পারব, সেটা হচ্ছে, বঙ্গদেশের কথাটা যদি আমরা ধরি, এবং বঙ্গদেশ দিয়ে আপনি পাঞ্জাব অন্যান্য প্রদেশ এগুলোর কথাও ভাবতে পারেন। সেটা হচ্ছে, বঙ্গদেশে শতশত বছর বাস করেছে হিন্দু এবং মুসলমান। কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যিকারের সৌহার্দ্য–এটা কোনোকালেই তৈরি হয়নি। চাষীতে চাষীতে মারামারি কম হয়, কিন্তু ভদ্রলোক ভদ্রলোকে মারামারিটা বেশি হয়। ঝগড়াঝাটি বেশি হয়। সম্পত্তি নিয়ে মামলা হয়। চাষীর ক্ষমতা নেই সে একটা চাষীর বিরুদ্ধে মামলা করবে। তো যখন থেকে মিডলক্লাস বলে একটা জিনিস তৈরি হয়েছে, তখন থেকে ব্যাপকহারে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এবং ইংরেজ আমলে এটা হলো, তার একটা কারণ হচ্ছে ইংরেজদের সরাসরি উস্কানি। উস্কানি কেন দিল? তার কারণ, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়তে তারা দেখল মুসলমানরা এবং হিন্দুরা একত্রে লড়াই করছে। এইটা তারা চায়নি। তারা চাইছে ডিভাইড এন্ড রুল। ডিভাইড এন্ড রুল কথাটা এসেছেই ১৮৫৭ সালের পরে। এবং তখন ১৮৭০/৭২ সালে হান্টারকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিল ইংরেজরা, মুসলমানদের পক্ষে।
রাজু আলাউদ্দিন: বইটার নাম বোধহয় দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস
গোলাম মুরশিদ: নাম মনে নেই। নাম মনে না থাকলেও কিছু যায় আসে না। সেই সময় তারা মুসলমানদেরকে নিজেদের দলে নিয়ে আসতে চাইল। দেখাল যে মুসলমানদের আগের অবস্থা ভালো ছিল, এখনকার অবস্থা খারাপ। হুইচ ইস রাবিশ! মুসলমানরা আগে শতকরা নিরানব্বই জন ছিল চাষী। পুরুষানুক্রমিকভাবে চাষী। মুসলমানদের অন্য কোনো পেশা ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা কি পূর্ববঙ্গে?
গোলাম মুরশিদ: পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ মিলে। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে তারা বলল যে আমরা বাইরে থেকে এসেছি। ১৮৭২ সালের যে সেনসাস, সেই সেনসাস অনুসারে যে মুসলমানরা বলেছে যে আমরা বাইরে থেকে এসেছি, তাদের সংখ্যা ছিল ১.৫২ পার্সেন্ট, শতকরা দেড়জন। আর সাড়ে আটানব্বই জন হচ্ছে বাংলাদেশের, বলছে তারা। তো এই যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, তারা পুরুষানুক্রমিকভাবে চাষী, জমির ওপর নির্ভরশীল। এবং তখন যে জমি ছিল, সেটা সাফিশিয়েন্ট ছিল সবার জন্যে। বেঁচে থাকার জন্যে। তার কারণ, কলেরায় মরে যায় লোক। বসন্তে মরে যায় লোক। সবচে' বেশি মরে ম্যালেরিয়ায়। লোকসংখ্যা বাড়ছে না। জমি সমানই থাকছে। বাড়িতে দাদাদাদি জন্মেছিল। তাদের ছ'টা, সাতটা, দশটা বাচ্চা হত, তার মধ্যে বাঁচত দুটোতিনটা। এইভাবে তাদের সংখ্যা চিরদিন সমান ছিল। যেমন পুঠিয়ায় একটা জরিপ হয়েছে। সেই জরিপে দেখা যায়, সেখানে ১৯০১ সালে যে সংখ্যক মুসলমান ছিল, ১৯৬১ সালেও মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় সমান ছিল। তার কারণ, ম্যালেরিয়া। তার কারণ এই তিনটা রোগ। এটা একদম ছাপানো তথ্য। মুসলমানদের পেট্রোনাইজ করার জন্য বলতে হবে যে, মুসলমানরা আগে ভালো ছিল, ইংরেজ আমলে, আমাদের আমলে খারাপ হয়ে গেছে, সুতরাং তাদের প্রতি আমাদের যত্ন নেয়া উচিত। সেই যত্ন নিতে গিয়ে তাদের জন্য মক্তব করল। স্কুল করল না। এটা মতলব। মাদরাসা করল। এই সমস্ত করল। সেখানে লেখাপড়া করে ইংরেজিও শিখছে না, অঙ্কও শিখছে না। এবং সেই সামান্য লেখাপড়া নিয়ে যে চাকরিটা পাওয়া সম্ভব সেটা হচ্ছে দারোয়ানের চাকরি। সেটা হচ্ছে অফিসের কেরানি না, কেরানির নিচে যারা থাকে, পিয়ন, তাদের চাকরি পাওয়া সম্ভব, কেমন? এবং সেই চাকরি দিয়ে তাদেরকে সমান করার চেষ্টা করল ইংরেজরা। তারপর ১৮৯০ সালের দিকে নতুন আরেকটা আইন হলো, যদি কোয়ালিফিকেশন একই থাকে, তাহলে চাকরিটা পাবে মুসলমান। তার কারণ, মুসলমান যতদিন পর্যন্ত চাকরির দিক থেকে হিন্দুদের সমান না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই সুবিধা দেয়া হবে মুসলমানদের। সে জন্য হিন্দুরা গেল চটে। আরে আমি অনেক শিক্ষিত লোক, আমাকে চাকরি না দিয়ে দেয় মুসলমানকে! সেই জন্য এক সময় নজরুলকে ঠাট্টা করে বলা হয়েছিল: নজরুল এক সময় বিভিন্ন দেবতাদের নামটাম করেছেন, এখন দেখতে পাচ্ছি তিনিও শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ। শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ মানে উনিও মুসলমান। এটা নিয়ে ছাপানো প্রবন্ধ আছে। আমার বইয়ের মধ্যেও উদ্ধৃতি আছে। তো এই হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বড় একটা কারণ–আর্থিক। আরেকটা কারণ, ১৮৭২ সালে জেলা স্কুলগুলোয় ক্লাশ নাইন-টেনের বেতন ছিল চার টাকা। আর তখন একজন কৃষকের মজুরি ছিল সারাদিন দু আনা। দু আনা মানে মাসে পৌনে চার টাকা। আর বেতন হচ্ছে চার টাকা, স্কুলে পড়ানোর। আর সমস্ত টাকা দিয়ে তো আর স্কুলে পড়ানো যাবে না। আরো তো খরচ আছে। খেতে তো হবে। সুতরাং তারা পড়াতে পারেনি। পড়ানোর দরকারও হয়নি তখন। কারণ, তখন জমি সাফিশিয়ান্ট ছিল। কিন্তু ১৯০০ সালের পরে ম্যালেরিয়া দমনের ওষুধ যখন বেরোল, স্যার রস এইটা আবিষ্কার করলেন কলকাতায় বসে, ১৮৯৮ সালে, ম্যালেরিয়া কমতে শুরু করল। তারপর অন্যান্য ওষুধ, বিশেষ করে টিকা চালু হলো। ফলে কলেরা কমল। বসন্ত কমল। অর্থাৎ জমির উপর চাপ বাড়ল। আগে লোক কম ছিল, জমি সমান ছিল। এখন জমি সমান আছে কিন্তু লোক বাড়ছে। ফলে মুসলমানরা বোধ করল আমাদের বোধহয় এখন লেখাপড়া শেখা উচিত। লেখাপড়া শেখার একটা সুযোগও এল। যখন বঙ্গভঙ্গ হলো। বঙ্গভঙ্গের সময় ঢাকা বিকেইম ক্যাপিটল অব ইস্ট বেঙ্গল। ঢাকায় মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে গেল। তারা লেখাপড়া শিখতে শুরু করল। তারপর এল ঢাকা ইউনিভার্সিটি। অমুকের বাড়িতে জায়গির থেকে তুই বিএ পড়, কেমন? এইগুলো যারা লিখেছে তারা রাবিশ লিখেছে এতদিন পর্যন্ত। তারা এই কথা না লিখে লিখেছে কী? ইংরেজরা আসার ফলে মুসলমানরা লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে গেল। দেড় পর্সেন্ট যারা ছিল, তারা লেখাপড়া করল কি করল না তাতে তো কিছু যায় আসে না। ৯৮.৫% যারা, তারা লেখাপড়া করল না। তারা জমির উপরে নির্ভর করে থাকল। লেখাপড়া করল আমীর আলী। আমীর আলীর পরিবার হচ্ছে উর্দু স্পিকিং পরিবার। লেখাপড়া করল ঢাকার নবাবরা। উর্দু স্পিকিং পরিবার। লেখাপড়া করল সোহরাওয়ার্দীরা। উর্দু স্পিকিং। লেখাপড়া করল গজনবিরা। তারা উর্দু স্পিকিং। বাঙালিরা তো করেনি। মিথ্যা ইন্টারপেটেশন দিয়ে এতদিন এই গবেষণা হয়েছে। আমার বই, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে আমি এর প্রতিবাদ করেছি।
রাজু আলাউদ্দিন: জয়া চ্যাটার্জি বঙ্গভঙ্গ নিয়ে যে বইটা লিখেছেন…
গোলাম মুরশিদ: আমি বইটা পড়িনি। এরা অনেকেই প্যাট্রোনাইজিং ইতিহাস লিখেছে।
রাজু আলাউদ্দিন: বিষয়টা কী রকম?
গোলাম মুরশিদ: মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে একটু পপুলার হওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা মুসলমানদের পক্ষে বলেছে।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু উনি তো অনেক তথ্যটথ্য দিয়ে লিখেছেন।
গোলাম মুরশিদ: তথ্য দিয়েই তো সবাই গবেষণা করে। সে তো নজরুল গবেষণাও তথ্য দিয়ে হয়েছে।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু তথ্যকে যাচাই বাছাই করা হয়নি এটা বলতে চাচ্ছেন?
গোলাম মুরশিদ: হয়নি। এবং নিরপেক্ষ তথ্য দেয়া হয়নি।
রাজু আলাউদ্দিন: তো এই বাংলায় এবং ভারতে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ক্রমশই বেড়ে উঠছে, এর পেছনের ঐতিহাসিক কারণ কী?


ছবি:রুম্মান তার্শফিক
গোলাম মুরশিদ: ঐতিহাসিক কারণ তো খুব সহজ। আপনি সমস্ত বেঙ্গলে ভোটারের সংখ্যা ছিল দশ হাজারের চেয়ে কম, ১৯০৯ সাল পর্যন্ত। ১৯০৯ সালে এটা বাড়িয়ে দেয়া হলো, হয়ে গেল পাঁচগুণ সাতগুণ, ভোটারের সংখ্যা। এবং তখন থেকে নিয়ম হলো লোকসংখ্যা অনুসারে আসন সংখ্যা হবে, ১৯০৯ সালে। আসন সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে গেল মুসলমানদের। ভোটার বাড়ল না মুসলমানদের। আসন বাড়ল। ভোটার বাড়ল না, তার কারণ, ভোট দিতে গেলে একটা মিনিমাম কোয়ালিফিকেশন দরকার। হয় লেখাপড়ার, নয়তো সম্পত্তির, নয় খাজনা দেয়ার।
রাজু আলাউদ্দিন: এর কোনোটাই ছিল না?
গোলাম মুরশিদ: এর কোনোটাই মুসলমানদের ছিল না। এবং ১৯১৯ সালে সেইটা আরো বাড়ল। ভোটারের সংখ্যা। মুসলমানরা মেজরিটি ভোটার হয়ে গেল। যেখানে মুসলমান ভোটার খুব কম ছিল। হাতে গোণা যায় এমন। তারপরে ১৯৩৫ সালে মুসলমানরা মেজরিটি। মুসলমানরা চিফ মিনিস্টার। মুসলমানরা মেয়র। মুসলমানরা সবকিছু।
রাজু আলাউদ্দিন: এরসাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্কটা কোথায়?
গোলাম মুরশিদ: সম্পর্কটা হচ্ছে হিন্দুরা এটা দেখে ফোঁসফোঁস করছে। মুসলমানরা হইহই করছে। রাজনীতিবিদরা এটাকে উপাদান হিসেবে নিয়ে নিল। নমোশূদ্রদের পর্যন্ত সিট দিয়ে দিল। যোগেন মণ্ডল, সে হলো একজন বড় নেতা। তাকে নিয়ে মুসলমানরা মিলে হিন্দুদের ঠকাল। তাকে নিতে হয়েছে মুসলমানদের। এইভাবে রাজনীতিটা সেক্যুলার থেকে হয়ে গেল কমিউনাল রাজনীতি। বুঝতে পেরেছেন? আমি হয়তো নতুন একটা ইন্টারপ্রিটেশন দিলাম বলে আপনার কাছে একটু অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু আমার ইন্টারপ্রিটেশন হচ্ছে বেইজ্ড অন ফ্যাক্টস। কতজন ভোটার কবে ছিল আমার হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বইটাতে পাবেন। কটা সিট মুসলমানদের, কজন ভোটর মুসলমানদের।
রাজু আলাউদ্দিন: মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
গোলাম মুরশিদ: এর ভূমিকা তো আমি চিন্তা করিনি। কারণ আমি সর্বভারতীয় রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করিনি। কিন্তু বাংলা স্পিকিং বাঙালি ফজলুল হক কী করে নেতা হলেন সেইটা অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। কারণ ভোট দিত বাঙালিরা, নেতা হতেন সোহরাওয়ার্দী। আর এখন ভোট দিল কৃষক শ্রমিক পার্টির লোকেরা, এবং নেতা হলেন বাঙালি, বাংলাভাষি। এভাবেই হয়েছে।
রাজু আলাউদ্দিন: তো এখন আমাদের দেশে, ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। ভারতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নাগরিক আইন, আপনি নিশ্চয় এগুলো লক্ষ করছেন।
গোলাম মুরশিদ: লক্ষ করছি। আমার ধারণা সারা পৃথিবীতে এখন ডানপন্থীদের রাজত্ব চলছে। সারা পৃথিবীতে। এবং তার পেছনে ধর্মও একটা বড় ফ্যাক্টর। সুতরাং মোদির জন্য হিন্দুত্বের জয়গান করা ছাড়া উপায় নেই ক্ষমতায় থাকা। ক্ষমতায় থাকতে গেলে এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গেলে তার হিন্দুত্বের উপর নির্ভর করতে হবে, মুসলমানকে মারতে হবে- এই হচ্ছে তার নীতি। সব দেশেই তাই হচ্ছে। এটা গচ্ছে আমার ধারণা।
রাজু আলাউদ্দিন: আমাদের দেশের অবস্থা কী রকম?
গোলাম মুরশিদ: সেইটা বলতে পারব না।
রাজু আলাউদ্দিন: আগামী বছর থেকে মুজিববর্ষ শুরু হচ্ছে। মাত্র আর কয়েকটা দিন বাকি। এই দেশ বাংলাদেশ না হয়ে যদি মুজিবদেশ হতো তাহলে ভুল হতো না। যদি কেউ বলত, সেটা নির্ভুলই হতো। আপনি একটু ব্যাখ্যা করেন এটার।
গোলাম মুরশিদ: দেখুন শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ অভিন্ন। কোনো নেতা জন্মাননি এদেশে, আগে অথবা পরে, যিনি এই দেশটাকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের নামে।
রাজু আলাউদ্দিন: কিন্তু আরো তো অনেক নেতা ছিলেন।
গোলাম মুরশিদ: অনেক নেতা ছিলেন। তারা কেউই একত্রিত করতে পারেননি। ১৬৯ আসনের মধ্যে ২/৩ টা ছাড়া সমস্ত আসন পেয়েছিলেন এই ভদ্রলোক। তিনি আমাদের বাঙালিদের একত্রিত করে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন। এবং তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন ৭ মার্চ। সেদিন তিনি বলেছিলেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। সেইটেই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এরপর যারা বাংলাদেশ নিয়ে লড়াই করেছেন তারা লড়াই করেছেন তারই আদেশ বা আহ্বানে। নয়তো অন্য কারো আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি যুদ্ধ শুরু করেনি। বা বাঙালি জাতি যুদ্ধ শুরু করে জয়ী হয়নি। শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের অভিন্ন পরিচয়। এবং আমি মনে করি, শেখ মুজিব যদি জন্মগ্রহণ না করতেন তাহলে আজও আমরা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকতাম। আমরা পাকিস্তানের একটা উপনিবেশ হিসেবে এখনো কাজ করতাম। এটিই আমার বিশ্বাস।


রাজু আলাউদ্দিন: আরেকটা জিনিস। বঙ্গবন্ধু যে লিখতেন, এটা আমরা জানতামই না। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি অসমাপ্ত আত্মজীবনী বেরোল। এরপর বেরোল কারাগারের রোজনামচা। আরো একটা বই বেরোতে যাচ্ছে তার। সেটা হলো উনি চিনে ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেটা নিয়েও একটা লেখা আছে। এই বইগুলো যদি আপনি পড়ে থাকেন, তাহলে আমার প্রশ্ন হলো লেখক বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
গোলাম মুরশিদ: তিনি খুব সিনসিয়ারলি লিখেছেন। এবং এখানে তিনি কোনো আত্মম্ভরিতা দেখাননি। তিনি সবিনয় সত্য কথাটা লিখেছেন। এই বইগুলো থেকে তার অন্য একটা চেহারা আমরা জানতে পারি।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি বইটার ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে। আপনি কি ইংরেজি অনুবাদটা পড়েছেন?
গোলাম মুরশিদ: ইংরেজি অনুবাদটা আমি দেখেছি। অনুবাদটা খুব সুন্দর হয়েছে বলে অনেক সমালোচক লিখেছেন পত্রিকায়।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার মূল বইটার প্রশংসা তো রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্তের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি করেছেন।
গোলাম মুরশিদ: তা করেছেন। এবং একটা জিনিস, আমার আশার ছলনে ভুলিরও ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়েছে। সেইটে করেছেন গোপা মজুমদার। সেই বইটার নাম লিওর্ড বাই হোপ আ বায়োগ্রফি অব মাইকেল মধুসূদন ডাট। সেইটা ছাপিয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।
রাজু আলাউদ্দিন: ইন্ডিয়ান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি?
গোলাম মুরশিদ: হ্যাঁ। এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি আমার আরেকটি বই করেছে। লাইফ এন্ড লেটারস অব মাইকেল মধুসূদন ডাট। সেইটা আমি লিখেছি। পুরোটাই।
রাজু আলাউদ্দিন: ওইটা ইংরেজিতেই সরাসরি লিখেছেন?
গোলাম মুরশিদ: সরাসরি ইংরেজিতে আমি লিখেছি। আরেকটা লিখেছি রিল্যাক্ট্যান্ট ডেবুট্যান্ট
রাজু আলাউদ্দিন: এটা তো প্রথমে ইংরেজিতেই আপনি লিখেছেন।
গোলাম মুরশিদ: এগুলোর মধ্যে আমি যেখানে পেরেছি, আগে তো বেরিয়েছে বাংলায়, নতুন উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছি।
রাজু আলাউদ্দিন: এবার নতুন কী বই বের হচ্ছে? কোনো প্রস্তুতি আছে?
গোলাম মুরশিদ: প্রস্তুতি আছে। বই ছাপা প্রায় শেষ। রবীন্দ্রনাথের নারী-ভাবনা। এই বইয়ের মেকাপ করা হয়ে গেছে। আমি নির্ঘণ্ট তৈরি করে ফেলেছি।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার জন্য শুভকামনা রইল। অনেক সময় দিলেন মুরশিদ ভাই। বা অনেক সময় ছিনিয়ে নিলাম আপনার।
গোলাম মুরশিদ: আপনার সাথে কথা বলা আনন্দের।
রাজু আলাউদ্দিন: থ্যাংক ইউ।