ইংল্যান্ড গোটা দেশটাই একটা আইল্যান্ড। তাই সমুদ্র দেখার জন্য জায়গার অভাব নেই এখানে। মোটরওয়েতে তখন সাঁই সাঁই করে গাড়ির পর গাড়ি ছুটতে দেখা যায়। বেশিরভাগ গাড়িগুলোতেই লাগানো থাকে ট্রেইলার। ট্রেইলার বা গাড়ির ছাদ ঠাসা থাকে সার্ফিং আর ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জামাদি দিয়ে। আর গাড়ির মিউজিক প্লেয়ারে হাই ভলিউমে চলতে থাকে গান। ব্রিটিশ মোটরওয়ের এই উৎসবমুখর পরিবেশ দেখার মতো একটা ব্যাপার বটে!
ভাবলাম ইংরেজদের সঙ্গে আমরাও হাওয়ায় গা ভাসাই। বর্নমাউথ যাওয়ার সব বুকিং যখন সম্পন্ন তখন নবী ভাই দিলেন পাশার দান উল্টে! গ্রীষ্মে এখানকার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ঘুরতে যাওয়া ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। নবী ভাই বললেন খরচ-টরচ করে যাবোই যখন 'কর্নওয়ালেই' যাই না কেন! 'কর্নওয়াল' ঘুরে আসলে নাকি ইংল্যান্ডে সমুদ্র দেখার জন্য আর কোথায় যেতে ইচ্ছে করবে না!
সেইন্ট মাইকেল মাউন্ট ক্যাসেল
তাদের কথাবার্তায় কিছুটা দমে গেলেও পিছপা হলাম না। ঝাড়া তিনদিন চিরুনি অভিযান চালিয়ে সৌভাগ্যক্রমে এয়ারবিএনবিতে একটা থাকার জায়গা পেয়ে গেলাম, তাও মোটামুটি কম খরচেই। আর সঙ্গে সঙ্গেই ফেইসবুক গ্রুপগুলোতে গিয়ে ব্যঙ্গকারীদের কৌশলে এক হাত নিতে ভুল করলাম না।
ছোট-বড় প্রচুর বালুকাময় সমুদ্র সৈকত থাকায়, কর্নওয়াল এখন ইংল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। সমুদ্র আর পাহাড়ের মেলবন্ধনে এক ভূস্বর্গের নাম কর্নওয়াল! সার্ফিং, ফিশিং, প্যারা সেইলিং-সহ নানা রকম ওয়াটার অ্যাক্টিভিটির জন্য কর্নওয়াল ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে প্রথম সারির পছন্দের জায়গা।
তবে পুরাতত্ত্বের দিক দিয়েও কর্নওয়াল সমৃদ্ধ। প্রচুর ঐতিহাসিক দুর্গ আর প্রাসাদ আছে এখানে। ইংল্যান্ডের এই কাউন্টির একমাত্র শহর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হচ্ছে ট্রুরো। কর্নওয়ালের উত্তর ও পশ্চিম দিকে কেল্টিক সাগর, দক্ষিণে ইংলিশ চ্যানেল আর পূর্ব দিকে টেমার নদী। এখানকার লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। কর্নিশ জাতির আবাসভূমি এবং প্রাচীন ছয়টি কেল্টিয় দেশের একটি বলে কর্নওয়ালকে গণ্য করা হয়।
ল্যান্ডস এন্ড
রেস্টহাউজ থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই 'নিউকোয়ের গ্রেট ওয়েস্টার্ন' সমুদ্র সৈকত। আমাদের মনও সমুদ্র দর্শনের জন্য উদ্বেল ছিলো। তাই থাকার জায়গা নিয়ে সেই মুহূর্তে খুব বেশি মাথা ঘামালাম না। আমি অবশ্য আরেকটু বেশিই ব্যাকুল। কারণ আমার চার বছরের কন্যা মোয়ানার জন্মদিন। বাচ্চাটার জন্মদিনে ওকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবো মনে মনে এমন একটি ইচ্ছে পুষে রেখেছিলাম।
পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম! সমুদ্রের এমন রূপ তো আগে দেখিনি! স্বচ্ছ নীল জলরাশি পাহাড়ের গায়ে এসে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার কিসের এক মায়ায় ফিরে ফিরে আসছে বারবার। এ যেন অভিমানী যুগলের মধুর খুনসুটি। অনেকখানি ঢালু পথ দিয়ে নেমে সমুদ্রকে যখন খুব কাছে পেলাম তখন আরেকবার বিহ্বল হবার পালা! পোড়া চোখ নিয়ে সমুদ্রের কাছে অনেকবার গিয়েছি। আর প্রতিবার সমুদ্রকে আবিষ্কার করেছি নতুন রূপে। এবার এলাম আমার রাজকন্যাকে নিয়ে, সমুদ্রকন্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।
'মোয়ানা' যার নামের অর্থ গভীর জলরাশি, সমুদ্রের সঙ্গে তার ভাব হতে সময় লাগে না। আমি অপার বিস্ময়ে কন্যার সমুদ্র অবগাহন দেখি। সমুদ্রের গর্জনে কান পেতে শুনি নতুন এক বন্ধুত্বের আগমনী বার্তা।
আমরা ফিরে যাই রেস্ট হাউজে। রাত কাটে আমাদের গল্পে আর গানে, হাহা হিহি করে। চিকেন উইংস আর ল্যাম্ব চপে কামড় বসাতে বসাতে তাস পেটানোও বন্ধ থাকে না। একটা পুরো দিন আর দুটো রাত আমরা আয়েস করেই কাটিয়ে দিই।
টিন্টাজেল ক্যাসেল
'সেইন্ট মাইকেল মাউন্ট ক্যাসেল' দেখতে যাবো যেদিন, মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। টিকেট আগে থেকেই কাটা ছিলো, অগত্যা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই চলে গেলাম। সেইন্ট মাইকেল মাউন্ট যেন আমাদের ছেঁড়া দ্বীপ। যাওয়ার সময় হেঁটেই ক্যাসেলে প্রবেশ করলাম, কিন্তু ফিরতে হলো নৌকায় করে। মিনিট দশেকের বোট জার্নি মনে করিয়ে দিলো ট্রলারে করে সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে যাওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। এ দুর্গের বাগানটা আমাকে আকর্ষণ করলো খুব। চমৎকার সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে আর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটি বিকেল কাটানোর অভিলাষটা ধামাচাপা দিতে হলো বৃষ্টির উৎপাতে। বৃষ্টির মতো সুন্দর একটা ব্যাপার মাঝে মাঝে যে ভীষণ আপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পা না দিলে বুঝতামই না!
শেষ দিনে রাস্তায় যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়েও অনেক দেরিতে গন্তব্যস্থল 'ল্যান্ডস এন্ড' পৌঁছালাম আমরা। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এই দুর্গতি। ঢাকার রাস্তার জ্যামের কথা মনে করিয়ে দিলো। ভিনদেশে পড়ে থাকলেও দেশকে ভোলার জো নেই। ভালো-মন্দে প্রিয় স্বদেশ বারবার মনের আঙ্গিনায় এক্কাদোক্কা খেলে।
আট ফুট লম্বা কিং আর্থারের ব্রোঞ্জের মূর্তি 'গ্যালোস'
পর্যটকরা বিখ্যাত ল্যান্ডস এন্ড সাইন এর নিচে ছবি তোলার জন্য বিশাল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই, তাই ওদিকে পা মাড়ালাম না। রওয়ানা দিলাম পরবর্তী গন্তব্যে, ল্যান্ডস এন্ড থেকে চার মাইল দূরে 'মিনাক থিয়েটারের' উদ্দেশ্যে।
'মিনাক থিয়েটার' একটি উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ। কর্নিশ ভাষায় মিনাক শব্দের অর্থ পাথুরে জায়গা। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে পাহাড়ের উপর নির্মিত থিয়েটারটির অনবদ্য নির্মাণশৈলী দেখে হাজার বছর আগের গ্রিক বা রোমান স্থাপত্য বলে মনে হয়। যদিও থিয়েটারটির বয়স একশো বছরেরও কম।
থিয়েটারটি বানিয়েছিলেন রোয়েনা কেইড নামের এক ভদ্রমহিলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি ও তার মা কর্নওয়ালে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। মিনাক পয়েন্টে চমৎকার বাগান সমেত তিনি একটি বাড়ি তৈরি করেন। ১৯৩২ সালে এই বাগানেই প্রথম মঞ্চায়িত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের 'দ্য টেম্পেস্ট' নাটকটি। এরপর থেকে প্রতি গ্রীষ্মে নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যে কেইড তার দলবল নিয়ে শীতকালে কাজে নেমে পড়তেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের পূর্ণাংগ এই থিয়েটারটি। এমন একটা নৈসর্গিক জায়গায় বসে থিয়েটার দেখছি এই ভাবনাটাই আমাকে বিস্মিত করলো। যদিও সেদিন কোন মঞ্চনাটকের প্রদর্শনী না থাকায় দেখার সৌভাগ্য হলো না। থিয়েটারটির বাগানে এখনও নানা ধরনের গাছপালা আর ফুলের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। আগ্রহীরা চাইলে কিনেও আনতে পারবেন।
‘মোয়ানা’ যার নামের অর্থ গভীর জলরাশি
কর্নওয়াল ট্যুরটি আরেকটি বিশেষ কারণে আমার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কর্নওয়ালে বসেই কোপা আমেরিকা ফুটবলের ফাইনালে ব্রাজিলকে ব্রাজিলের মাঠে হারিয়ে প্রিয় দল আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখি। আর্জেন্টিনার হয়ে লিওনেল মেসির হাতে আরাধ্য একটি ট্রফি! কর্নওয়ালকে লক্ষ্মীমন্ত ভাবতেই হচ্ছে।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |