পশ্চিমবঙ্গে এখন নজরুল চর্চার অবস্থা

বেবী মওদুদ
Published : 28 May 2010, 07:38 AM
Updated : 28 May 2010, 07:38 AM

…….
কাজী নজরুল ইসলাম
…….
পশ্চিমবঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সঙ্গীতের চর্চা এবং গবেষণা খুব যে উল্লেখযোগ্য ভাবে হচ্ছে তা কিন্তু বলা যাবে না। সরকারি উদ্যোগ তেমন চোখে পড়লো না। তবে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে নজরুলকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেন। কলকাতায় বাংলা একাডেমি নজরুল রচনাবলি সাত খণ্ডে প্রকাশ করেছে। ঢাকার বাংলা একাডেমী দশ খণ্ডে প্রকাশ করেছে, এরপর আরও লেখা পাওয়া গেছে যা দিয়ে দু'খণ্ড প্রকাশ করা যাবে।

পশ্চিমবঙ্গে নজরুল চর্চা সম্পর্কে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ তানভীর নাসরীন আমাকে বলেছেন, "এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই কবিকে স্মরণ করা হয়। যারা পছন্দ করে নজরুল সঙ্গীত শেখে। তবে আমাদের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর কবির জন্মদিনে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এছাড়া বাংলা বিভাগের অধীনে 'নজরুল চেয়ার' আছে, সেখানে নজরুল সাহিত্যের ওপর গবেষণার ব্যবস্থা আছে।"

……
আবু মোহাম্মদ ফজলে কাদের
……..
কলকাতায় বিশিষ্ট বিজ্ঞান সাধক ও রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার অনুবাদক মোহাম্মদ ফজলে কাদেরের সাক্ষাৎকার নেবার সময় তিনি স্মরণ করলেন, ১৯৪০ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে কবিকে এক সম্বর্ধনা সভায় তিনি প্রথম দেখেন। তিনি বলেন, "আমি তখন কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্র। আমাদের কাছে নজরুল একটি বড় শক্তি ছিলেন, উজ্জ্বল আদর্শ ছিলেন। তিনি আসবেন শুনে আমরা গিয়ে হলে উপস্থিত হয়েছি। তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। কবি বেশ দেরি করে এলেন। মাথা ভর্তি ঘাড়সমান কালো চুল, ডাগর বড় বড় চোখ, পাঞ্জাবী পরনে। ফয়েজ জাহান আমীন ও জিনাত জাহান নামে দু'জন কিশোরী কবিকে মালা পরিয়ে দেন। আমাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল কবির অভিভাষণ। সম্ভবতঃ সেটাই তাঁর শেষ বক্তব্য প্রদান। আমরা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাঁকে দেখছিলাম, তাঁর ভাষণের কথাগুলো কানে ঠিকই ঢুকছিল। কখনও জোরালো, কখনও ধীরস্থির, ক্ষোভ-অভিমানও ছিল সেই কণ্ঠে।

পরে আমার চাচাশ্বশুরের আবদুল ওয়াহিদ এন্ড সন্স বেকারিতে রুটি তৈরির কাজ করতেন। তিনি তখনও গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন, পুঁথি পড়তেন। মানুষ আগ্রহী হয়ে শুনতো। কিন্তু তিনি যে একদিন বড় কবি হবেন, সেটা তখনও কারও চিন্তা-ভাবনায় ছিল না।"

পশ্চিমবঙ্গে নজরুল চর্চা সম্পর্কে ফজলে কাদের বলেন, "এখানে তো প্রথমদিকে নজরুল চর্চা ও গবেষণা ভালোই ছিল। পরে কমে গেছে। নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজার । সেই গানের চর্চা ও শেখার আগ্রহও এখন আর খুব একটা নেই। ১১ জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মদিন এলে কোথাও কোথাও অনুষ্ঠান হয়, তখনই যা শোনা যায়।"

কলকাতা মাদ্রাসা থেকে ইংরেজী মাধ্যমে লেখাপড়া করে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েন মোহাম্মদ ফজলে কাদের। ড. কুদরত-এ-খুদার স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন, "নজরুল সঙ্গীত শুনতে সবাই পছন্দ করে ঠিকই, কিন্তু এখানকার বেতার, টিভি চ্যানেল বা সিডিতে নজরুল সঙ্গীতের কোনো প্রচার নেই। এটা বড় দুঃখজনক। একসময় এইচএমভি কোম্পানির স্টুডিওতে বসে তিনি সঙ্গীত রচনা করতেন ও সুর দিতেন। শিল্পীদের শিখিয়ে রেকর্ড করাতেন। নজরুলের সাহিত্য নিয়ে গাবেষণা করার জন্য মেধাবী মানুষের বড় অভাব। শুনেছি তাঁর সম্পর্কে জানার মানুষের আগ্রহও অনেক কমে গেছে।"

জিজ্ঞেস করলাম, "কলকাতায় নজরুলের অনেক স্মৃতি, সাহিত্য চর্চা, সঙ্গীত সাধনা, রাজনীতি, পত্রিকা সম্পাদনা, কারাবন্দী জীবন এসব নিয়েও তো অনেক কাজ করা যায়?" ফজলে কাদের বললেন, "হ্যাঁ, অনেক স্মৃতি, অনেক সংগ্রাম, অজস্র লিখেছেন। এখানেই রেডিওতে শিশুদের অনুষ্ঠানে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। অসুস্থতায় এক অস্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্থ হন। খুব কষ্টে কেটেছে তাঁর সংসার। ওষধ কেনারও পয়সা ছিল না। সেই নীরব হয়ে যাওয়া কবি সরব হলেন না আর। কিন্তু তাঁকে কেন ভুলে যেতে হবে? নজরুল চর্চা, প্রচার ও বিকাশ অবশ্যই আরও বেশি করে হওয়া উচিত। পাঠ্যবইয়ে তাঁর লেখা আছে, সঞ্চিতা ছাড়া তেমন কোনো কবিতার বইও পাওয়া যায় না।"

নজরুল সম্পর্কে অনেক গল্প কলকাতায় বসে তাঁরা শুনেছেন। ফজলে কাদের বললেন, "তাঁর টাকা-পয়সা ছিল না সত্য, তবে হৃদয় অনেক বড় ছিল। পূর্ণিমার রাতে গঙ্গায় নদীতে যখন লঞ্চে চড়ে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতেন, তখন নজরুলের অট্টহাসি ও গান সবাই উপভোগ করতো। আর একবার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে গোয়ালন্দ গেছেন। সেখানে লঞ্চে উঠে দেখা গেল, কারও কাছে পয়সা-কড়ি নেই। তখন নজরুল ডেকে বসে গান ধরলেন। শ্রোতাদের ভিড় জমে গেল, টাকা পয়সাও পড়ছে ভালো। হঠাৎ ক্যাপ্টেন এসে কবিকে বললেন, আপনি এমন জায়গায় বসেন যেন লঞ্চ একদিকে হেলে না পড়ে। এরকম অনেক গল্প আমাদের ছাত্রজীবনে শোনা যেত। নজরুল হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীর মানুষের প্রিয় ছিলেন তাঁর লেখার জন্য। অসাম্য-অন্যায়-অবিচার-অনীতির বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী মানুষকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করতো। তাঁর আসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনাবোধ বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। তাঁর সেই ভাষণের কথাগুলো মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছি।"

ফজলে কাদের আরও জানান, "নজরুল 'আমপারা'র বাংলা অনুবাদ করেছেন এটা অনেক বড় কাজ। তিনি খুব ভালো আরবী-ফারসী-উর্দু -হিন্দী জানতেন। বিশেষ করে 'বিদ্রোহী' কবিতায় হিন্দু পুরাণের অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাঁর সঙ্গীতে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সঙ্গীতের রাগ ব্যবহার করেছেন। তিনি জ্ঞানার্জনের সময়টুকু কখনও অবহেলা করেন নি, তবে তাঁর মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর তো স্বভাবজাত ছিল। কবি নজরুল ছিলেন প্রকৃত অর্থে স্বশিক্ষিত এবং প্রতিভাশালী কবি। বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনকে উজ্জ্বীবিত করতে তিনি জাগরণী গান লিখলেন, দেশাত্মবোধক গান শোনালেন। বৃটিশরা তাঁর লেখনী বন্ধ করতে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করে তাঁকে জেলে ঢোকালো। কবি সেই জেলে বসে লিখলেন, 'লাথি মার ভাঙ্গরে তালা, যতসব বন্দীশালা'। নজরুল বাংলার কবি, বাঙালির প্রিয় কবি। নজরুল মানুষের কবি। কবি হিসেবে তিনি যেমন প্রেমিক বিদ্রোহী, আবার মানবতার কবি হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত।"

ফজলে কাদেরের স্ত্রী কিশওয়ার জাহান কলকাতায় একজন বিশিষ্ট সমাজকল্যাণ নেত্রী। কৈশোরে মহাত্মা গান্ধীর সান্ধ্য প্রার্থনা সভায় নজরুলের বাংলা অনুবাদ করা সুরা পাঠ করে শোনাতেন। তিনিও দুঃখ করে বললেন, "নজরুলের প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।"

পশ্চিমবঙ্গে নীরবে-নিভৃতে নজরুল চর্চা ও বিকাশ সাধনায় ব্যস্ত রয়েছেন নজরুল সংস্কৃতি পরিষদ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মীরাতুন নাহার। কলকাতা শহরের একজন বিশিষ্ট লেখিকা। ইংরেজি-বাংলা-উর্দু ভাষায় সমানভাবে লিখে থাকেন, অনুবাদও করেন। 'রোকেয়া বিশেষজ্ঞ' হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। মীরাতুন নাহার আমাকে বলেন, "এখানে কে কী করছে আমি বলতে পারবো না। তবে আমরা গত সাত বছর ধরে পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছি। প্রতি সংখ্যায় নজরুল সাহিত্য ও সঙ্গীতের এক একটি দিক নিয়ে অনেকের লেখা থাকে যার সাহিত্যমূল্য আছে এবং পাঠকদের আকৃষ্ট করে। আমরা নজরুলের আদর্শিক ভাবনা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। আমাদের পত্রিকা গ্রামে গ্রামে চলে যায়।"

এবার কলকাতায় বই কিনতে গিয়েও দেখলাম প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠান রূপা প্রকাশনী সুমন্ত সেনের লেখা ইংরেজী ভাষায় নজরুলের ওপর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। বিদেশীদের কাছে নজরুলকে তুলে ধরার জন্য একটি চমৎকার গ্রন্থ এটি। নজরুল সাহিত্য সম্পর্কে নতুন কোনও গবেষণালব্ধ গ্রন্থ চোখে পড়ে না।