বিদঘুটে হলেও সত্যি যে, ছোটদের চেয়ে বড়দের আলোচনাতে অংশ নিতেই সে বেশী ভালবাসে।
Published : 11 Mar 2025, 04:16 PM
১.
একটি সুপ্রশস্ত নামাযের ঘর। ফজর নামাজের জামাত আরম্ভ হয়েছে। ইতোমধ্যে নিয়্যাত, তাকবির, কিরাত, রুকু, সিজদা সেরে নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত মুসল্লিরা দাঁড়িয়েছে সবাই এক সাথে, ইমামের পেছনে। প্রথম রাকাতের চেয়েও যেন বেশী ধ্যানমগ্ন তারা! যতই সময় গড়িয়েছে, ইন্দ্রিয়গুলোকে একে একে শক্ত করে টেনে ধরেছে তারা – অচিন এই সফরে যেন কোথাও পালাবার পথ নেই সেগুলোর!
কিন্তু হঠাৎই একটা তীব্র ডানা ঝাপটানি! আর তার মুহুর্মুহু শব্দ-শেলে ভীত-সন্ত্রস্ত ইন্দ্রিয়গুলো হুড়মুড় করে খুলতে শুরু করে! একটি শিশু দৌঁড়ে যাচ্ছে সবার সামনে দিয়ে, ফিরে আসছে আবার, আবার যাচ্ছে, আবার ফিরছে…যেন একটি ঘূর্ণি চক্র রাইড দিয়েই যাচ্ছে, রাউন্ডের পর রাউন্ড, থামার এতটুকু লক্ষণ নেই!
দন্ডায়মান মুসল্লিরা অবাক নয়নে তাকায় শিশুটির দিক; কিন্তু কেউই নামায ভাঙে না। কারো ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে, কারো মুখ আর ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে, সুরা মেলাতে যেয়ে কারো বা হয়ে যাচ্ছে ভুল। কারো সামনের চটের জায়নামায লন্ডভন্ড, কারো তো প্রায় গায়ে গা লেগে যাচ্ছে শিশুটির, আবার কোথাও বা হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে স্থির হচ্ছে শিশুটি। কিন্তু তারপরও মুসল্লিরা নির্বাক দর্শক হয়েই থাকে; কারণ নামাযের এই সময়ে যখন খতিব সাহেবের গমগমে কণ্ঠ ঐশ্বরিক ঢেউ তুলে যাচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে, তখন তাদের অনুমতি নেই ধ্যানভঙ্গের।
অথচ এই ছেলেটিই কিনা তাদের সবার সামনে একে একে হাঁটু গেড়ে বসছিল আর লাল কটির নীচে ক্ষুদে হাতটা ঢুকিয়ে সুগন্ধি আতর বের করে আনছিল! কি যেন এক টান ছিল সেই ক্ষুদে শিশিটির- সবাই হাতটা এগিয়ে দিচ্ছিল শশব্যস্ত হয়ে। কেউ কেউ তো লাইন ভেঙে ছুটে আসছিল একটুখানি আতরের ভাগ পেতে। সম্ভবত ছেলেটিকে তাদের মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ এক ফেরেশতা! আর তার আঙ্গুলের এতটুকু স্পর্শেই যেন বেহেশতি সুরার স্বাদ!
তবে শুধু নামায শেষ হওয়ার প্রতীক্ষাটুকুই ছিল - তারপর তো দুই কাঁধে ঠিকঠাক সালাম ফেরাতেও ভুল হল, আর বন্যার তোড়ে বাঁধ ভাঙার মতই গরম কথার তীর ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে এল শিশুটির বাবার উপর। যদিও তাকে কেউ চেনে না, অথবা, সে যে কোথায় অবস্থান করছে তাও জানা নেই কারো, এমনকি সে আদৌ এসেছে কিনা, তারও ছিল না কোন নিশ্চয়তা; তবু ঘোর বর্ষার দিনের মত অঝোর ধারায় বইতে লাগল গালের গুলিগুলো। এই গায়েবি গালাগালগুলি যেন অনেকটা গায়েবি জানাজার মতই প্রার্থী ডেকে আনলো কাতারে কাতারে; যেকোন গায়েবী জিনিসের মতই এর আকর্ষণ, আর এ কারণেই অন্য যেকোন দিনের থেকে নামায ঘরটা ফাঁকা হতে আজ অনেকটা সময় বেশী লেগে গেল।
২.
‘আব্বু, স্কুলে এ পর্যন্ত তোমার কতগুলি বন্ধু হয়েছে?’
ভীষণ বিরক্ত হন মুনির সাহেব। কী আজব প্রশ্ন! এর সাথে তার পাপনের পাগল-পাগল আচরণের কী সম্পর্ক থাকতে পারে! ওর যে পাগলা বাতিকগুলো আছে, সেগুলি নিয়ে প্রশ্ন করার কোন লক্ষণই আর দেখা যাচ্ছে না! আর এগুলি নিয়ে বিশদ বলার জন্য মনে মনে বেশ কবার রিহার্সেল দিয়েই তো ঢুকেছেন সেন্টারটিতে। বলতে কি, পাপন যে শুধু নামাযের সামনে দিয়ে দৌঁড়ুয়, তা না; আরো অনেক বলার মত উপসর্গ আছে তার! নামাযেরটিকে বরং সর্বসাম্প্রতিক বলা যেতে পারে; তাছাড়া, এটা মাত্রাও ছাড়িয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই! সেদিন নামায শেষে কী করে যে ছেলেটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন, তা কেবল তিনিই জানেন!
সেদিন বাড়ির পথে দৌঁড়ুতে দৌঁড়ুতে ভেবেছিলেন, পিটিয়ে চামড়া লাল করে দেবেন পুঁচকে শয়তানটার! কিন্তু গায়ে হাতটা উঠাতেই লক্ষ্য করলেন, পাপন এক মনে চিবিয়ে যাচ্ছে দরজার উপর মেলে দেয়া তোয়ালের কোণাটুকু। কাপড়-চোপড় চিবুনোয় ওর দক্ষতা দিনদিন কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছে! ছিদ্র না হওয়া পর্যন্ত খেয়ে যেতেই থাকবে, তা যতই বকাঝকা আর শাসনের বেড়ি নেমে আসুক না কেন!
‘তোমার কোন জিনিসগুলো ভাল লাগে, আর কী কী ভাল লাগে না, বলবে আমায়, বাবা?’ ডাক্তার সাহেব ‘আব্বু’ থেকে এখন ‘বাবা’তে নেমে এসেছেন। মুনির সাহেব ফের বিরক্ত হন। বোঝাই যাচ্ছে, যখন যেটা মাথায় আসছে গড়গড় করে উগড়ে দিচ্ছেন, আর মোটা ফিসের বিনিময়ে তার জন্য বরাদ্দ স্লটটুকু একটু একটু করে ফিনিশিং লাইনে টেনে নিচ্ছেন। সম্ভবত তার ছেলের সমস্যাটা এই মনোরোগ বিশারদটির মাথাতেই নেই! না হলে পাপনের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাবা হিসেবে সরাসরি তার কাছ থেকেই জেনে নিতে পারতেন লক্ষণগুলো! তবে প্রশ্ন করা হল আর পাপন সোনা উত্তর দিয়ে দিল – সেরকমও তো নয়! সে কখন ঠোঁট ফাঁক করবে, আর কখন আস্ত দেহটাকেই মুখগহবরে বন্দী করে নিতে চাইবে ঠোঁটের কপাটে খিল দিয়ে, সেও তো কারো জানা থাকে না! বলতে কি, পাপন যে দুনিয়ার কোন জিনিসটা পছন্দ করে, আর কোনটা করে না, বাপ হয়ে তা তিনি নিজেই জেনে উঠতে পারেননি এতদিনে! কখনো তো মনে হয়, দুনিয়ার সব কিছুকেই সে ভালবাসে! আবার কখনো কখনো মনে হয়, সব কিছুতেই ওর ঘেন্না, প্রবল অনাসক্তি!
যেমন, পাপন নিজে কারো কোন প্রশ্নের উত্তর না দিলেও অন্যকে ঠিকই অস্থির করে ফেলবে যদি তাকে তার প্রশ্নের উত্তর দানের জন্য উপযুক্ত মনে হয়। এছাড়া, মানুষকে মুখের উপর যা-তা টাইপ কথা শুনিয়ে দেয়ার বাতিক আছে তার। একবার তো এক প্রতিবেশী খালাম্মাকে বলে বসল, “ঘরে বাজার করার পয়সা নাই..আরেকটা বাচ্চা ক্যান?”, আর ওদিকে পাপনদের বাড়ির গার্জেনরা মরমে মরে যেতে লাগলো…তাদের একান্ত ঘরোয়া কথাকে এভাবে কপি করে ছেড়ে দেবে বিচ্ছুটা!
বিদঘুটে হলেও সত্যি যে, ছোটদের চেয়ে বড়দের আলোচনাতে অংশ নিতেই সে বেশী ভালবাসে। এইতো কিছুদিন আগে তার বাবা রাজনৈতিক রাজা-উজির মারছিলেন এক পুরনো অফিস কলিগের সাথে। বলা নাই কওয়া নাই পাপন মাঝখান থেকে সেই আংকেলকে থামিয়ে দিল, “না, এটা ষড়যন্ত্র! ষড়যন্ত্র!” ছেলের বেয়াদবিতে হতবাক বাবা তখন মাথায় হাত রেখে মনে করার চেষ্টা করছিলেন, সম্প্রতি তিনি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপর কোন আর্টিকেল পত্রিকায় পড়েছিলেন কিনা যখন পাপন তার সাথেই ছিল!
‘আপনার ছেলের একটা সমস্যা আছে। একটু জটিল হলেও এর ভাল চিকিৎসা আছে। শুধু একটু কেয়ার…” অবশেষে তার দিকে নজর দেয়ার সময় হয়েছে লোকটির – ডাক্তারটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কথাগুলি আবার সাজিয়ে নিতে থাকেন মুনির সাহেব; তার কেন জানি মনে হল, লক্ষণগুলো বিশদে না বললে চিকিৎসাটাও ভুল হবে!
৩.
পাপন বড় কাউকে পেলেই গল্প শুনতে চাইত। যতক্ষণ না গল্প বেরুচ্ছে, ততক্ষণে সে পাগল হয়ে যেত। আর গল্প তাকে এতটাই আনমনা করে দিত যে, যে আংকেল বা আন্টি গল্প শোনাত, তার হাত ধরে যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারত! কাউকে তার মনে পড়ত না তখন - মা, বাবা, ভাই বোন, চাচা চাচি, মামা মামি কাউকে না। যখন তাদের বাড়িতে কেউ আসতো, তাকেই সে তার গল্পকার বানিয়ে নিত; যেন তাকে গল্প শোনাতেই তার আসা! কয়েকদিন থেকে ঐ অতিথিটি যখন ফিরে যেত, তখন অন্যদের সাথে সাথে সেও কাঁদার চেষ্টা করত; তারপর ঠিকমত হচ্ছে না দেখে কান্নাটা থামিয়ে দিত, আর হাসত আপন মনেই!
পাপনের বন্ধু ছিল না, তা না। কিন্তু বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, বা তাদেরকে সময় দেয়া তার কাছে প্রায়ই সময়ের অপচয় মনে হত। সে বরং নাটকের মত করে সংলাপ আওড়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে পছন্দ করত! তাকে দেখে তখন মনে হত, সামনেই একটা স্টেজ, আর সে কোন নাটকে অভিনয় করছে। এছাড়া কোন কোন দিন সে ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি দেখে কাটাত; তবে কার্টুন না, নিউজ চ্যানেলগুলোই ছিল তার সব থেকে প্রিয়। তামিল অ্যাকশান সিনেমাগুলির চেয়েও সে বেশি উপভোগ করত বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন দলের নেতাদের যুক্তি-তক্কো-গপ্পো-বাদানুবাদ। এ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর আসতো, কার্টুন নাকি সব দেখা তার শেষ। এখন নতুন কিছু দেখতে চায় সে।
ইঁচরেপানার উপসর্গ তার আরো ছিল; যেমন, সে অফিস করতে চাইত এই বয়সেই। আর ছিল বাবার সাথে বিতর্কে অংশ নেয়া। এবং সেসব কঠিন সব বিষয় নিয়ে, যেমন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি। বিষয়টা এমন করে শুরু হত যে – সে একটা বিষয় বাবাকে জিজ্ঞাসা করত, আর বাবা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে গেলে, সে মেনে নিতে পারত না সেই ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। এভাবে একটি নিছক প্রশ্নোত্তর পর্ব বিতর্কে রূপ পেলে বাবা একটা পর্যায়ে বাকরুদ্ধ হয়ে ড্রইয়িং রুমের সোফা ছেড়ে উঠে যেত!
পাপনের লক্ষণগুলো আরো আগে থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিল; আর সে অনুযায়ী ডাক্তারও দেখানো হচ্ছিল। প্রথম শুরু হয়েছিল হোমিপ্যাথিক দিয়ে। সবটা শুনে নিয়ে হোমিও ডাক্তার জানিয়েছিল যে, এটা একটি ব্যাধি। আর ডাক্তারের দেয়া দানা দানা ঔষুধগুলো যা পাপন মহানন্দে খেত, যেন কাজও করল বলে মনে হল অভিভাবকদের। বেশ কিছুদিন অন্তত তাকে আর কাপড় চিবুতে দেখা যায়নি। কিন্তু উপসর্গ তো থেমে থাকে না। নতুন নতুন হাজির হয়। গ্রামে দাদির খোয়ার থেকে মুর্গি ধরে নিয়ে মাঝ পুকুরে ছুঁড়ে দিয়ে পরে তার জন্য পাড়ে অপেক্ষা করা অন্যদের চোখে নিষ্ঠুরতার নিদর্শন হতে পারে, কিন্তু পাপনের কাছে ছিল চরম আনন্দের একটা খেলা। আর এই খেলায় শংকিত হয়ে দাদি তাকে নিয়ে যায় ফকিরের অন্দরে। সেখানকার দাওয়াইগুলি অবশ্য বিশ্রী ধরণের ছিল; মুখে নিতেই পারত না পাপন; প্রায়ই বমি হয়ে যেত! আশ্চর্য হল, এরপরেও কাজ হল; আর দাদি বলতে লাগলেন, “ঔষুধতো কিছু না, একটা উসিলা মাত্র; আসল কাজ তো করেন তেনার রুহু, বদ জ্বীনের মরণ তো তেনার হাতে!”
৪.
আগের চিকিৎসাগুলির ধারাবাহিকতা এবারও বজায় রইল; ডাক্তারের ঔষুধে কাজ হল বলেই মনে হল মুনীর সাহেবের; আর পাপন বদলে যেতে লাগল। তাকে আগের থেকে অনেক নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃংখল দেখাল। মুনির সাহেব ছেলেকে নিয়ে আবার গেলেন নামায ঘরে। ছেলেটিকে বসিয়ে যখন তিনি নিজেও বসলেন, তখন অন্যদিনের মত মাথা নীচু করে থাকলেন না তিনি। আশেপাশে সবার দিকে চাইতে লাগলেন; আর মাঝে মাঝে ছেলেকেও টুকটাক আদেশ প্রদান করতে লাগলেন, নিতান্তই অনাবশ্যক কিছু বিষয়ে; যেমন, পাঞ্জাবির হাতাটা আরেকটু গোটাও, পায়জামাটা আরেকটু ভাঁজ করে গোড়ালিটা ফাঁকা রাখো, চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে ফেল, আসন করে বস, আদবের সাথে বস….। এমন নয় যে, পাপন এগুলো জানে না, বা, নিজে থেকেই করত না; কিন্তু মুনির সাহেব ছেলেকে নিয়ে যেন আজ কোন আসরে এসেছেন; ছেলের একটা পারফরমেন্স আশা করছেন তিনি, যা দেখে সবাই হাততালিতে ফেটে পড়বে!
যখন জামাতের জন্য ইকামত শুরু হল, দাঁড়িয়ে গেল সার বাঁধা সব মুসল্লিরা! মুনির সাহেব পাপনকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন, যেন সে একা একা উঠতে পারবে না! এইটুকু সতর্কতাই হয়ত কাল হল, কারণ এতে পাপনের দাঁড়াতে ক্ষণিক বিলম্ব হল, আর সে চোখে পড়ে গেল এক মুসল্লির যে কিনা এই নামাযঘরেই পাপনের সীমাহীন দুরন্তপনার জীবন্ত সাক্ষী ছিল! তারপর আর যায় কোথায়! আরে এই বাচ্চাটা এখানে কেন! ওকে কে নিয়ে এল! বের করে দাও!
অচিরেই বেঁধে গেল এক মহা হুলুস্থুল! আর সর্বত্র যা হয়, এই নামাযঘরেও দুটো দল তৈরী হল, আপনাআপনি, সংবদ্ধ প্রচারণা ছাড়াই। একটা গ্রুপ, ছেলেটি যেন আর মসজিদে না আসতে পারে, সে ব্যাপারে কঠোর ফতোয়া জারি করল। অন্য আরেকটি দল, এই ফতোয়া অবৈধ, মানি না -এরকম স্লোগান দিতে লাগল। তাদের মত হল, একটি শিশু বাচ্চা, তার আবার পাপ বা পূন্য! এছাড়া ছেলেটিকে তো দিব্যি সুস্থই দেখাচ্ছে, তাই না? ওকে তো সেদিনের ঘটনাটার পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে সার্টিফিকেট দেখুক সবাই! দু পক্ষের এই ভীষণ ডামাডোলের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোন ফয়সালা কোর্টের রায়ের মত করেই স্থগিত থাকল; আর সেই ফাঁকে পাপনকে তার পাশেই নামাযের জন্য দাঁড় করিয়ে দিতে পারলেন মুনির সাহেব।
৫.
চারদিক পিনপতন নিরবতা। শেষ বসন্তের একটা ঝিম ধরানো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে বাইরে, আর তার ঢেউ নামায ঘরেও হুহু করে ঢুকছে আর অন্য রকম এক ভাব-শিহরণের আবেশ মাখিয়ে দিচ্ছে সমবেত মুসল্লিদের গায়ে। অন্য যেকোন দিনের চেয়েও যেন তারা সৃষ্টিকর্তার আরো নিকটবর্তী আজ! এত জন্মের ইবাদত বন্দেগী সফল হতে পারে আজই, এমনকি সাক্ষাৎ মিলতে পারে তার কোন নিদর্শনের!
হঠাৎ একটি বিকট শব্দ! অতঃপর কিছুটা সয়ে নিতে সক্ষম হলে মুসল্লীদের কানে এল কিছু বাক্য, গগনবিদারি স্বরে যা প্রকম্পিত করে তুললো চারপাশ! সেই সংলাপগুলো যেন ভিনদেশী ভাষায় রচিত হয়েছিল, ব্যাকরণের সাথে কোন ধরনের সংযোগ না রেখেই; কারো পক্ষেই তার পাঠোদ্ধার কর সম্ভব হল না! কিছুক্ষণের মধ্যেই নামাযঘরে দন্ডায়মান শত শত মুসল্লি লক্ষ্য করল - একটি ছেলে বিপুল বেগে ছুটছে মুসল্লিদের লাইনের সমান লম্বা জায়নামাযের প্রান্ত ছুঁয়ে; তার তীব্র পাখা ঝাপ্টানিতে কেঁপে উঠছে মুসল্লিদের রক্তমাংসের নরম পালকগুলি!
একটা পর্যায়ে ছেলেটি হা হা করে হাসতে লাগল। আর তারপর যে শব্দগুলো ভেসে আসতে লাগলো, তা আগের মত পুরো দুর্বোধ্য ছিল না; এমনকি, উপস্থিত দুর্বল কানগুলোও যেন স্পষ্ট শুনতে পেল একটি ক্ষুদে কণ্ঠের ঝাঁঝাল আবেদন “ভোট চাই ভোটারের, দোয়া চাই সকলের!“