Published : 02 May 2025, 09:55 PM
মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে বিতর্ক ও বিরোধিতার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলে এ ব্যাপারে ‘সবার’ সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পরে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “মানবিক করিডরে আমরা রাজি যদি জাতিসংঘ এটার উদ্যোগ নেয়। এই পুরো জিনিসটা হবে দুইটা দেশের সাথে কথা বলে।
“জাতিসংঘ যখন কাজ করে তারা সেখানে সংশ্লিষ্টদের সাথে অর্থাৎ মিয়ারমার সরকারের সাথেও কথা বলবে, আমাদের সাথেও কথা বলবে। বলে তারপরই তো সিদ্ধান্তে আসবে।”
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের পর গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের ‘মানবিক সহায়তা চ্যানেল’ বিষয়ে প্রথম ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।
৭ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয় প্রথম আসার কথা তুলে ধরে ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন তিনি।
“তাকে আমরা বলেছি, রাখাইনে যে মানবিক সমস্যা, যে সংকট সেটা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিকল্প নাই। সেই কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই হবে।”
তার ওই বক্তব্যের প্রায় তিন সপ্তাহ পর গত রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মানবিক প্যাসেজ’ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি এটুকু আপনাদেরকে বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এটাতে সম্মত। কারণ, মানবিক প্যাসেজ হবে।
“কিন্তু এটাতে আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেটার বিস্তারিততে যাচ্ছি না, সেই শর্তাবলী যদি পালিত হয়, আমরা এটাতে অবশ্যই সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।”
তার ওই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বিরোধিতার মুখে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ’ বা ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়া নিয়ে ‘জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার’ সঙ্গে সরকারের কোনো আলোচনা হয়নি।
এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ''যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ যৌক্তিক পরিকাঠামোগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।''
এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার এক বার্তায় রাখাইনে মানবিক সহায়তা নেওয়ার পথ তৈরির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ যদি জড়িত হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হওয়ার কথা বলেছে বৈশ্বিক সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়।
শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলন, রাখাইনে ‘মানবিক করিডোরের’ কথা আসছে কারণ সেখানে গৃহযুদ্ধের মত একটি সহিংসতা চলছে। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যারা আছে, রাখাইনে যারা আছে, সেখানে মানবিক একটা সংকট হয়েছে।
করিডোর নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব কথা বলছে সেটাকে ‘প্রিম্যাচিউর’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, “এটা সর্বসম্মতিক্রমে হবে। আর আমরা মনে করি যে এখনো এটা অনেক অনেক দূরের বিষয়। আমরা তো বলেছি, এটা যখন চূড়ান্ত বিষয়ে আসবে তখন সবার সাথে কথা বলে, এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।”
এসময় প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, চট্টগ্রামের ডিসি ফরিদা খানম, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের অর্ন্তবর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগ
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়েও কথা বলেছেন।
এক সংবাদিকের প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ ও অপারেটর আসতে পারে।
“আমরা সেই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলছি যাদের ৭০-৮০টা বন্দরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। অন্তবর্তী সরকার চাচ্ছে এটা সেপ্টেম্ববের মধ্যে শেষ করতে।”
বন্দরের অপারেটর নিয়োগ প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, “আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই পুরো প্রক্রিয়াটা খুবই স্বচ্ছ হবে। পৃথিবীতে যারা নাম করা কোম্পানি, তাদের সাথে আমরা কথা বলব। যে জায়গায় আমরা যেতে চাই, সে জায়াগায় যেতে হলে নাম্বার ওয়ান কোম্পানিকে আমাদের ধরতে হবে, যার সুনাম নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এমন সব কোম্পানির সঙ্গে আমরা কথা বলব।”
ছোট-খাটো কোম্পানি এনে বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এতে হয়তো দুই-একটা লোকের বা গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার হবে। সেটা আমাদের লক্ষ্য না।”
এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের মূল লক্ষ্য হল বাংলাদেশকে পণ্য উৎপাদনের হাব হিসেবে তৈরি করা। এই হাব শুধু বাংলাদেশের ১৮ কোটি লোকের জন্য না, এই অঞ্চলের ৩০-৪০ কোটি মানুষের জন্য। এটি হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে সামনে রেখে।
‘‘যে পণ্য এখানে তৈরি হবে, যেটি মানুষ এসে বানাবে; সে পণ্য শুধু আশপাশের দেশে বিক্রি করবেন না। তা বিদেশেও রপ্তানি করবেন। চট্টগ্রামের (বন্দরের) যতগুলো টার্মিনাল আছে সবগুলোকে সক্ষম করতে হবে।”
সক্ষমতার বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, চট্টগ্রামের আশপাশে সব বন্দর মিলিয়ে সক্ষমতা হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ ৭০ হাজার কন্টেইনার (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের)। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে এটাকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৭৮ লাখ ৬০ হাজারে নেওয়া। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও পণ্য উৎপাদন হাব করতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা প্রথম শর্ত।
রাষ্ট্র সংস্কার
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্র সংস্কারকে অর্ন্তবর্তী সরকারের মূল কাজ বল মন্তব্য করেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা যে ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে গেছেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যে অতল গহ্বরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন সে জায়গা থেকে তুলে আনাটা আমাদের মানে এ সরকারের একটা বড় কাজ।
‘‘এই যে পুরো দেয়ালে দেয়ালে এটা কি লেখা? এই যে আমাদের ছেলেরা যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তারা কি লিখেছেন? তারা লিখেছেন রাষ্ট্র সংস্কার। রাষ্ট্র সংস্কারটা হল আমাদের মূল বার্তা। রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে অর্থনীতি সংস্কারটা মূল।”
নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, “নির্বাচন তো অবশ্যই, আমরা সব কাজ শেষে নির্বাচন দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর করে একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা রেখে আমরা চলে যাবো। এটাই হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ।”